
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ তরুণ উদ্যোক্তা, লেখক ও বক্তা সাবিরুল ইসলাম নিয়মিত লিখবেন প্রথম আলোয়। ‘স্বপ্ন নিয়ে’তে আজ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর কলাম
দিনটি ছিল ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩, যেদিন আমি তিন বছর বয়সে বাংলাদেশকে বিদায় জানিয়েছিলাম। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ২০ বছর পর সেই একই তারিখে (২২ সেপ্টেম্বর ২০১৩) আমি বাংলাদেশে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বিমানে উঠেছি। যে ভ্রমণ আমার জীবন বদলে দিয়েছে, সেই সঙ্গে উজ্জীবিত করেছে বাংলাদেশের লাখো তরুণের জীবনও।
বাংলাদেশ আমার পূর্বপুরুষের দেশ। তিন বছর ধরে আমি বাংলাদেশে আসার চেষ্টা চালিয়ে গেছি, আমার আপন দেশের মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি এবং স্বপ্ন দেখেছি তাদের জীবনে পরিবর্তন আনার। কিন্তু অনেকবার আমার মনে হয়েছে, তাঁরা আমাকে ঠিক আস্থায় নিতে পারছে না যে আমি এ দেশের তরুণদের কাছে নতুন বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষার পালা শেষ হয়। এজন্য আমি কৃতজ্ঞ জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনালের (জেসিআই) প্রেসিডেন্ট মুস্তাফিজুর রহমান ও জেসিআই বাংলাদেশের কর্মীদের প্রতি। তাঁরা আস্থা রেখেছেন আমার স্বপ্নের প্রতি। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁরা আমাকে বিশ্বাস করেছেন। আসলে এতবার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও ‘ইন্সপায়ার ওয়ান মিলিয়ন’ ক্যাম্পেইনকে বাংলাদেশে নিয়ে আসাটা সহজ ছিল না। কিন্তু জেসিআইয়ের উদ্যম ছিল সত্যি প্রশংসনীয় এবং আমরা শেষ পর্যন্ত তা সফল করতে পেরেছি।
আমাদের সফলতার অংশীদার হিসেবে অনেক সংগঠনকেই ধন্যবাদ দিতে হবে। তবে আমি সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ প্রথম আলোর কাছে। তারাই ছিল তরুণদের কাছে ‘ইন্সপায়ার ওয়ান মিলিয়ন’ ক্যাম্পেইনকে পৌঁছে দেওয়ার কণ্ঠস্বর।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে আমার মিশন শুরু হয়। সত্যি বলতে কি, আমি কখনো ভাবিনি যে বাংলাদেশে আমি এ রকম অভাবনীয় সাড়া পাব। আমার প্রথম অনুষ্ঠানের সময় থেকেই দেখলাম, সবকিছুই খুব স্বাভাবিকভাবে চলছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আমার নিজের শহর সিলেটে অসাধারণ সাড়া পেয়েছি। সবচেয়ে আনন্দের কথা হলো, আমরা আমাদের বার্তাটা এ দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি। এর ওপর বাড়তি পাওনা হলো, মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ও শুভেচ্ছাবার্তা। হূদয় ছুঁয়ে যাওয়া অনেক মেসেজই আমি ফেসবুকে পেয়েছি। এর মধ্যে একটির কথা বলছি: ‘সাবিরুল, আপনার বক্তব্য শুনে আমি খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছি। যদিও আমি সবার পেছনে বসেছিলাম, আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি সামনে এগিয়ে আসতে। জীবনে আমার সবচেয়ে বড় আক্ষেপ হলো, আমি আপনাকে ছুঁয়ে দেখতে পারিনি।’ সত্যি কথা বলতে কি, এটি ছিল অনেকেরই মনের কথা।
প্রতিটি শহরেই আমরা ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। ঢাকা শহরের প্রচণ্ড যানজটের মধ্যেও আমরা মোট ১২টি অনুষ্ঠান করেছি।
চট্টগ্রামে আমি যে দুটি অনুষ্ঠান করেছি, সেগুলোর কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। চট্টগ্রামে তরুণদের জানার আগ্রহ আর আত্মপ্রত্যয় আমাকে মুগ্ধ করেছে। তখন চট্টগ্রামে হরতাল চলছিল, তাই সবাই একসময় ধারণা করেছিল, আমাদের অনুষ্ঠানটি বাতিল করা হয়েছে। হরতালের জন্য প্রথমে অনুষ্ঠানে মাত্র ৩৫ জন শ্রোতা উপস্থিত হয়েছিল। কিন্তু বক্তৃতা শুরু হওয়ার পর প্রতিমুহূর্তেই শ্রোতাদের ভিড় বেড়েছে এবং ২০ মিনিটের মধ্যে মিলনায়তন পূর্ণ হয়ে যায়। অনুষ্ঠান বাতিল হয়নি—এই সংবাদটি এত দ্রুত ছড়াবে, এটা ছিল আমাদের অকল্পনীয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমার অভিজ্ঞতা একটু ভিন্ন ছিল। মজার ব্যাপার হলো, সেখানে সবাই জানত, আমি কে এবং কী করি। আমি অনেক হেসেছি, যখন আমি শুনতে পেলাম, সেখানে সবাই সাবিরুলের কথা শুনতে নয়, শুধুই তাঁকে দেখতে এসেছে!

সিলেটের অভিজ্ঞতা ছিল আমার জন্য খুবই আবেগময়। ২০ বছর পর আমি প্রথম আমার চাচা-চাচিকে দেখলাম। আমি তাঁদের সঙ্গে ছিলাম এবং গ্রামে গিয়ে আমাদের নতুন বানানো ঘরটি দেখলাম। সত্যি বলতে কি, গত ২০ বছর আমি তাঁদের ছেড়ে ছিলাম, ব্যাপারটা আমার চোখে পানি এনে দিয়েছিল। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানটি ছিল এককথায় ‘ওয়াও’। এটাই ছিল বাংলাদেশে ‘ইন্সপায়ার ওয়ান মিলিয়ন’ ক্যাম্পেইনের সবচেয়ে বড় সমাবেশ, যেখানে প্রায় দেড় হাজার শ্রোতা উপস্থিত ছিলেন। আমাদের মিলনায়তনের প্রতিটি কোনাই ছিল ভর্তি এবং আমি এর জন্য শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাব। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া এই সাফল্য কখনোই সম্ভব হতো না।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলাদেশে ‘ইন্সপায়ার ওয়ান মিলিয়ন’ ক্যাম্পেইন ব্যাপক প্রচারণা পাওয়ায় এর সাফলতা আরও বেড়ে গেছে। আমি খুবই খুশি যে আমার ক্যাম্পেইনের সাফল্য নিয়ে ভবিষ্যতে আরও অনেক ফলোআপ ফিচার বের হবে। প্রথম আলো আমার বইয়ের অনুবাদ করবে বলে কথা দিয়েছে। সেই সঙ্গে প্রথম আলো আমাকে ‘স্বপ্ন নিয়ে’ পাতায় নিয়মিত কলাম লেখার সুযোগ করে দেওয়ায় নিজ দেশের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ সহজ হয়েছে।
ডিসিসিআই আমার বোর্ড গেমের বাংলাদেশি সংস্করণ বাজারে ছাড়ার এবং চ্যানেল আই ব্যবসায় উদ্যোগ নিয়ে আমার টিভি শো সম্প্রচার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আমি সবাইকে বলেছি, এটাই শেষ নয়; বরং বাংলাদেশে আমার আসা-যাওয়ার এই তো সবে শুরু। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাংলাদেশে ‘ইন্সপায়ার ওয়ান মিলিয়ন’ ক্যাম্পেইনের শেষটা (যেটা এখন আট লাখ ৯০ হাজার+ সংখ্যায় আছে) আমি বাংলাদেশে করব এবং এতে ‘স্বপ্ন নিয়ে’র সব পাঠককে আমন্ত্রণ জানাই।
বাংলাদেশ সফরে আট দিনে আমি চারটি শহরে ১৬টি অনুষ্ঠানে বক্তব্য করেছি। যাঁরা আমার কথা শুনেছেন, প্রত্যেকেই এই ক্যাম্পেইনের সাফল্যের অংশীদার।
গল্পের কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আমি যখন বিমানবন্দরে গেলাম ওমানে আমার ফিরতি বিমান ধরতে, সেখানে সবাই, এমনকি পাইলট পর্যন্ত জানতেন আমি কে। সুতরাং, বিমানে আমার সহযাত্রীদের উদ্দেশেও আমাকে কিছু বলতে হলো।
বাংলাদেশ, আমি তোমায় ভালোবাসি, আমি তোমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আপনাদের সবাইকে আমি খুবি মিস করব। আশা করব, আপনারা ‘স্বপ্ন নিয়ে’তে আমার লেখা নিয়মিত পড়বেন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত