একটি ভয়ানক ব্যাধি

বাহ্যিক দৃষ্টিতে খুনের দায় ঐশীর ঘাড়ে, কিন্তু একটু গভীর দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যায়, কোনো কোমল হূদয় বা মানুষের বিবেক এই খুন করেনি। খুন করেছে ইয়াবা নামক এক মহাভয়ানক সর্বনাশা ওষুধ।

কিন্তু কী এই ইয়াবা? ইয়াবার মূল শব্দ থাই। এর সংক্ষিপ্ত অর্থ পাগলা ওষুধ। মূলত নেশাজাতীয় ওষুধ। এক ভয়াবহ মাদক যা মস্তিষ্ক, হূদ্যন্ত্র এবং শরীরের  যেকোনো অঙ্গকেই আক্রান্ত করতে পারে। ধীরে ধীরে নিস্তেজ করে দেয় একটি সুন্দর দেহ, মন ও মানসিকতার। এই ইয়াবা-আসক্তির কারণে মস্তিষ্কের বিকৃতি হতে পারে। ইয়াবার সঙ্গে মাঝে মাঝে ক্যাফেইন বা হেরোইন মেশানো হয়, যা আরও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এই মহাভয়ানক মাদক সেবন করলে মনে উৎফুল্ল ভাব তৈরি হয়, যৌন উত্তেজনা বেড়ে যায়, কিছুটা ওজন কমে, মনে উত্তেজনা আসে। তাই কৌতূহলবশত ইয়াবা সেবন করে থাকে অনেকে। কিন্তু কিছুদিন ইয়াবা সেবনের পর দেখা দিতে শুরু করে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। প্রথমেই শুরু হয় মানসিক অবসাদগ্রস্ততা। কৌতূহলবশত কয়েক দিন সেবনের পরই আসক্তি এমন পর্যায়ে যায় যে এটি ছেড়ে দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন ইয়াবা ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না। ফলে ওই মাদক পেতে যেকোনো হীন অপকর্ম করতেও হিতাহিত জ্ঞান থাকে না।

দেহে আসে মানসিক অবসাদ, ঘুম না হওয়া এবং মানুষের চিন্তা, আচরণে  বৈকল্য দেখা দেয়। মানুষ আর মানুষ থাকে না। হয়ে ওঠে হিংস্র, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। ন্যায়-অন্যায় বোধ লোপ পায়। হয়ে ওঠে অপরাধপ্রবণ। অনায়াসে মানুষকে খুনও করতে পারে। একটা সময়  শরীরের অন্যান্য অঙ্গও অকেজো হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির সেনাদের নিদ্রা, ক্ষুধা ও ক্লান্তিহীন করার জন্য ইয়াবাজাতীয় ওষুধ খাওয়ানো হতো। সেনারা হতো হিংস্র, ক্লান্তিহীন ও আগ্রাসী। কিন্তু একবার আসক্ত হয়ে যুদ্ধফেরত সেনারা মানসিক অবসাদগ্রস্ততায় ভুগত এবং আরও হিংস্র হয়ে উঠত। এক সেনা আরেক সেনাকে গুলি করে মারত, আবার কখনো নিজে আত্মহত্যা করত।

সামগ্রিক দৃষ্টিতে ইয়াবা সেবনে ক্ষতি অসীম ও অপূরণীয়ও বটে। এটি পরিবারকে ধ্বংস করে। সমাজকে করে কলুষিত এবং দেশকে করে পঙ্গু। পারিবারিক সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। এই মাদক জীবন থেকে জীবন কেড়ে নেয়। হূদয়ের আবেগ-অনুভূতি কেড়ে নেয়। আলোর পথ ছেড়ে নিয়ে যায় অন্ধকার পথে। স্বাধীন হূদয় পরিণত হয় নেশার দাসে।

প্রতিকার ও প্রতিরোধ

ইয়াবা-আসক্তি প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ শত গুণে সহজ। সুতরাং প্রতিরোধের ওপর বেশি মনোযোগ দিতে হবে। একবার কেউ আসক্ত হয়ে গেলে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করে বোঝাতে হবে। বকাবকি, তালাবদ্ধ করে রাখা ও রাগারাগি করা যাবে না। তাকে চিকিৎসার জন্য রাজি করিয়ে তার শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসার জন্য মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

আর প্রতিরোধ এককভাবে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ বা দেশের পক্ষে করা সম্ভব নয়। সবাইকে মিলেই এই প্রতিরোধযুদ্ধে নামতে হবে এবং এই যুদ্ধ চলমান রাখতে হবে। গড়ে তুলতে হবে মাদক প্রতিরোধ সামাজিক আন্দোলন। দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন ও সঠিক শিক্ষা মাদক প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এসব দায়িত্ব পরিবারের। আর সমাজ ও দেশের দায়িত্ব মাদকাসক্তব্যক্তিকে ঘৃণা ও অপরাধী হিসেবে বড় করে না দেখে কোথা থেকে, কীভাবে, কারা মাদক সরবরাহকারী বা কারা এসবের মূল হোতা, তাদের বিচার ও শাস্তির আওতায় আনা। তবেই এই মহাভয়ানক ইয়াবার ছোবল থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও  কোমলমতি সন্তানদের রক্ষা করা যাবে।

তাই এখনই উচিত সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে মাদকবিরোধী স্লোগানে সুর তোলা।

লেখক: ডিন, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।