ওয়াশিংটনের বাঙালি আড্ডা

কফি ক্লাবের আড্ডায়: সামনের সারি (বাঁ থেকে) ফখরুদ্দীন আহমদ, সৈয়দ জিয়াউর রহমান, নাজেম আহেমদ চৌধুরী ও ইকবাল বাহার চৌধুরী। আড্ডায় আরও আছেন, মোহসীন সিদ্দিক, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, সালাহ্উদ্দীন আহমেদ, আবুল সিদ্দিক, ওয়াহেদ হোসাইনী, হাসান ইমাম, আজমত আলী এবং রাইসউদ্দীন আহেমদ
কফি ক্লাবের আড্ডায়: সামনের সারি (বাঁ থেকে) ফখরুদ্দীন আহমদ, সৈয়দ জিয়াউর রহমান, নাজেম আহেমদ চৌধুরী ও ইকবাল বাহার চৌধুরী। আড্ডায় আরও আছেন, মোহসীন সিদ্দিক, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, সালাহ্উদ্দীন আহমেদ, আবুল সিদ্দিক, ওয়াহেদ হোসাইনী, হাসান ইমাম, আজমত আলী এবং রাইসউদ্দীন আহেমদ

‘বাংলা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির এক বড় উদ্দীপনা শক্তি—বাঙালির আড্ডা’—বলেছেন সাহিত্যে নোবেলজয়ী প্রখ্যাত জার্মান ঔপন্যাসিক গুন্টার গ্রাস। গুন্টার গ্রাস দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন কলকাতায়, বাংলাদেশেও এসেছিলেন তিনি। কলকাতায় তিনি নিয়মিত আড্ডা দিয়েছেন কফি হাউসে—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ সমকালীন বাংলা সাহিত্যের নামী লেখকদের সঙ্গে। প্রখ্যাত এই জার্মান লেখক তরুণ বয়সে আড্ডা দিয়েছেন বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বার্লিন, বন আর কলোন শহরেও। তাঁর মতে—‘আড্ডা প্রতিভা বিকাশের সহায়ক’। গুন্টার গ্রাসের আড্ডা জমানোর গল্প শুনেছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। কেবল গুন্টার গ্রাসই নন, যুগে যুগে বিশ্বের সর্বত্র শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বিজ্ঞানীসহ সব স্তরের বুদ্ধিজীবীরই আড্ডা-অনুরাগের ইতিহাস আছে। শিল্পী পাবলো পিকাসো দীর্ঘকাল আড্ডা জমিয়েছেন মাদ্রিদ আর প্যারিসে, বিশ্ব বিখ্যাত ফরাসি নাট্যকার জ্যাঁ পল সার্ত্রকে বলা হয়ে থাকে ফ্রান্সের রাজধানী শহরের এক কফি ক্লাবের আড্ডার প্রাণপুরুষ, মিসরের কায়রো শহরে দিনের পর দিন কফি হাউসে আড্ডা দিয়েছেন নোবেলজয়ী সাহিত্যিক নগিব মাহ্ফুজ। তেমনি ইস্তাম্বুলে নোবেলজয়ী তুির্ক লেখক ওরহান পামুক, টোকিওতে ইয়াসুনায়ি কাওয়াবাতা, আমেরিকার বস্টন শহরে প্রখ্যাত নাইজেরীয় সাহিত্যিক ওলে সোয়েঙ্কা, এমনকি বিজ্ঞানী আইনস্টাইনেরও আড্ডা জমানোর ইতিহাস আছে আমেরিকার নিউ জার্সি রাজ্যের কয়েকটি শহরে।

বাঙালির আড্ডা-অনুরাগের সবচেয়ে বড় প্রেরণা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কবিগুরু দিনের পর দিন আড্ডায় বসেছেন তাঁর অন্তরঙ্গ কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে। একবার ঘোর বর্ষার এক বর্ষণসিক্ত অলস দুপুরে নিঃসঙ্গতায় কাতর কবি বন্ধুকে উদ্দেশ করে কবিতা রচনা করেছেন ‘শ্রাবণের পত্র’ শিরোনামে:

‘আমলা-শামলা আঁটিয়া নিত্য

তুমি করো ডেপুটিত্ব

একা পড়ে মোর চিত্ত

করে ছটফট।’

সুতরাং নিঃসংশয়ে বলা চলে, বাঙালির এই আড্ডার ঐতিহ্য গৌরবময়।

১৯৫০-এর দশকে এবং ৬০-এর দশকেরও কিছু সময় ধরে ঢাকায় তরুণ বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের একটা বড় আড্ডা ছিল পুরোনো শহর এলাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক-বাংলা বাজার অঞ্চলের কাছাকাছি ‘বিউটি বোর্ডিং’ নামে দেয়ালঘেরা অনেকটা জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা একটি রেস্তোরাঁয়। সেখানে আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দিনের যেকোনো সময়ে আড্ডায় বসতাম নিরুদ্বেগে। বলতে গেলে প্রায় সারা দিনই ছিল আড্ডার সময়। এই আড্ডায় আসতেন কবি শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দীন আল-আজাদ, শিল্পী আমিনুল ইসলাম, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, কবি সাংবাদিক সাইয়িদ আতিকুল্লাহ্, ইংরেজি সংবাদপত্রের কলাম লেখক সঞ্জীব দত্ত, কবি-সাংবাদিক শহীদ সাবের, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, শিল্পী মুর্তজা বশীর, সাংবাদিক সাদেক খান এবং তখনকার ঢাকার প্রতিভাধর তরুণ কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সাংবাদিকদের অনেকেই। পরবর্তীকালে তাঁদের প্রায় সবাই অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন—নিজের নিজের ক্ষেত্রে।

একইভাবে আড্ডা বসত পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলী এলাকায় সাহিত্য পত্রিকা সওগাত কার্যালয়ে। ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে দীর্ঘকাল অন্য আরও কয়েকটি পত্রপত্রিকায় সংশ্লিষ্ট থাকার পাশাপাশি নিয়োজিত ছিলাম নাসিরুদ্দীন সাহেবের সাহিত্য পত্রিকা সওগাত ও মহিলা সাপ্তাহিক বেগম-এর সম্পাদনা কাজে। সে সময় সাংবাদিক-সাহিত্যিক বন্ধুবান্ধবেরা প্রায়ই দল বেঁধে সওগাত-এ আসতেন আড্ডা জমাতে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সওগাত অফিসের উল্টো দিকের জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতায় নিয়োজিত কবি হাসান হাফিজুর রহমান ও কথাসাহিত্যিক আলাউদ্দীন আল আজাদ আর আসতেন দৈনিক সংবাদ-এর সহকারী সম্পাদক কবি শহীদ সাবের, লেখক হুমায়ুন কাদির, কবি আবদুস সাত্তার এবং আরও অনেকে।

বাঙালির আড্ডা-অনুরাগের সবচেয়ে বড় প্রেরণা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাঙালির আড্ডা-অনুরাগের সবচেয়ে বড় প্রেরণা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এর সুদীর্ঘ অর্ধশতাব্দীকালেরও অনেক পরে দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে আমেরিকার রাজধানী শহর ওয়াশিংটনেও আড্ডার ঐতিহ্য রক্ষা করে চলেছেন বেশ কিছুসংখ্যক বাঙালি বুদ্ধিজীবী। তবে তাঁরা কেউ তরুণ নন, সবাই বর্ষীয়ান—ষাটোর্ধ্ব থেকে আশি-ঊর্ধ্ব বয়সের পর্যন্ত; এবং সবাই অবসর নিয়েছেন নিজের নিজের কর্মক্ষেত্র থেকে।

ওয়াশিংটন শহরের উপকণ্ঠে মেরিল্যান্ড রাজ্যের বেথেসডায় মন্টগোমারি মল নামে একটি বিপণিবিতানের এক কফি হাউসে বসে এই আড্ডা। সপ্তাহে এক দিন, প্রতি শনিবার সকাল ১১টা থেকে দু-তিন ঘণ্টা ধরে চলে কফির কাপ হাতে আড্ডা। এই আড্ডা পরিচিত ‘কফি ক্লাব’ নামে। ক্লাবের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় আছেন বিশিষ্ট প্রকৌশলী ও ব্যবসা-কর্মকর্তা আজমত আলী এবং আড্ডায় নিয়মিত যাঁরা যোগ দেন, তাঁদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক উপ-প্রধান রোমে এফএওর সাবেক কর্মকর্তা প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, সাবেক সিএসপি আমলা, বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা পাঁচ-ছয়টি গ্রন্থের রচয়িতা আজিজুল জলিল, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব ও রোমে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা সালাহ্উদ্দীন আহেমদ, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ড. রাইসউদ্দীন আহেমদ, আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ড. আবুল সিদ্দিক, বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ড. হাসান ইমাম, সাবেক সিএসপি আমলা ড. রশীদুর ফারুকী, প্রকৌশলী ও ঢাকার ইংরেজি পত্রপত্রিকায় নিবন্ধ লেখক ড. মোহসীন সিদ্দিক, ভার্জিনিয়ার বিশিষ্ট সমাজসেবী ওয়াহেদ হোসাইনী, সাবেক সিএসপি আমলা ও রাষ্ট্রদূত নাজেম আহমেদ চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন ছাড়াও ভয়েস অব আমেরিকা থেকে অবসর যাপনরত বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান ইকবাল বাহার চৌধুরী আর আমি।

আড্ডায় মাঝেমধ্যে আসেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ও বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান ফখরুদ্দীন আহমদ, বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ড. আবদুন নূর, সাবেক সিএসপি আমলা জিয়াউদ্দীন চৌধুরী, আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা নুরুন নবী চৌধুরী, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব কামাল উদ্দীন চৌধুরী এবং অতিথি হিসেবে ঢাকা থেকে আসতেন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।

এই আড্ডায় আলোচনার কোনো নির্দিষ্ট বিষয়সূচি থাকে না। আমেরিকার রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বের নানা বিষয় ও প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা- সমালোচনা ও মতবিনিময় চলে। অতীত স্মৃতিচারণাও করেন কেউ কেউ। নানা মতের নানা আদর্শের অনুসারী কফি ক্লাবের সদস্যবর্গের আলোচনা-সমালোচনায় কলহ-বিবাদ কিংবা মনান্তর ঘটে না কখনো, সবকিছু চলে সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে, হাসি-আনন্দের পরিবেশে। কখনো কখনো জ্ঞান-গর্ভ তাত্ত্বিক আলোচনা মতবিনিময় সত্ত্বেও এই আড্ডা সবার কাছেই হয়ে ওঠে যথার্থ উপভোগ্য। তা ছাড়া কফি ক্লাবের আড্ডার আলোচনা-মতবিনিময় থেকে নানা উপকরণ সংগ্রহে সক্ষম হন নিবন্ধ রচনায় উৎসাহী সদস্যবর্গ।

বছরে অন্তত দুবার ক্লাবের বনভোজন অনুষ্ঠিত হয় পরিবার-পরিজন নিয়ে কাছাকাছি বনাঞ্চলের কোনো পার্কে, অপরূপ নৈসর্গিক পারিপার্শ্বিকতায়।

মোটকথা, আড্ডার গৌরবময় ঐতিহ্য অনুসরণে মাতৃভূমি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বিশ্বের এই প্রান্তে ওয়াশিংটনের এই বাঙালি আড্ডা নিঃসন্দেহে অনন্য।

সৈয়দ জিয়াউর রহমান

সাংবাদিক, ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের সাবেক সিনিয়র এডিটর।