
পরীক্ষায় প্রায়ই ‘অমুক গল্প কিংবা উপন্যাসের তমুক চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো’-টাইপের প্রশ্ন আসে। কেমন হতো যদি একজন কট্টর সমালোচক পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি বিশ্লেষণ করতেন?
ভূমিকা
পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কুবের। উপন্যাসের নায়কও সে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার যে তার মধ্যে নায়কোচিত গুণাবলির ছিটেফোঁটাও নেই। সে চূড়ান্ত পর্যায়ের খ্যাত! বেরসিক, অসৎ এবং ভিতুর ডিম একটা! হোক সে মাঝি, হোক সে ‘গরিবের মধ্যেও গরিব’, ‘ছোটলোকের মধ্যেও ছোটলোক’, তাই বলে তার মধ্যে স্মার্টনেস থাকবে না, এটা কেমন কথা! তাহলে কোন যোগ্যতায় সে উপন্যাসের নায়ক হয়? নিচে একটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কুবের চরিত্রের নানা দুর্বলতা আলোচনা করা হলো।
‘বেরসিক’ কুবের
কুবেরের সহচর গণেশ একটু হ্যাবলা প্রকৃতির। উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায় ধনঞ্জয়ের নৌকায় করে মাছ ধরার একপর্যায়ে গণেশ কুবেরকে ‘একটা গীত ক দেখি কুবির’ বলে গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু কুবের কী করল? গান গাওয়া তো দূরের কথা গণেশকে সোজা ধাতের পেয়ে তার মুখের ওপর অত্যন্ত দুর্বিনীতভাবে ‘হ, গীত না তর মাথা’ বলে ‘না’ করে দেয়। নিতান্তই যদি তার গান না গাইতে ইচ্ছা করে তবে এভাবেও তো বলা যেত, ‘না রে গণেশ, এখন গানটান গাইতে ইচ্ছা করছে না।’ তা না, একেবারে বেরসিকের মতো এভাবে না করা মোটেও উচিত হয়নি। গান-বাদ্য যদি না-ই করল তবে তাকে উপন্যাসের নায়ক করা কেন? এমন তো আর নয় যে তার রূপ একেবারে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে!
‘অসৎ’ কুবের
নায়ক মানেই মানুষটি সৎ! অথচ নায়কের চিরায়ত এই বৈশিষ্ট্যকে কুবের মাঝি ইয়া বড় বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে! দুটি বাড়তি পয়সার লোভে সে ধনঞ্জয়ের নৌকা থেকে চুপিচুপি গোটা কতক ইলিশ মাছ সরিয়ে শীতলবাবুর কাছে বিক্রি করে। আবার হোসেন মিয়ার পকেট থেকেও কৌশলে টাকা সরিয়ে নেয়। তার এহেন কর্মকাণ্ডে পাঠক আনমনেই বলে ওঠে, ‘ছি কুবের মাঝি, ছি!’ চুরি করার আগে তার অন্তত একবার হলেও ভাবা উচিত ছিল যে সে এই উপন্যাসের নায়ক, যদু-মধু টাইপের কেউ না!
‘অস্থির’ কুবের
একে তো চুরি করে শীতলবাবুর কাছে মাছ বিক্রি করেছে, তার ওপর সে মাছের দামের জন্য একেবারে নাছোড়বান্দার মতো আচরণ করে। একটু ধৈর্যসহ্য না থাকলে কিসের নায়ক, কিসের কী! আর মানুষের বিপদ-আপদ তো থাকতেই পারে। অথচ কুবের তা মানতেই নারাজ। শীতলবাবু খুব দৃঢ়ভাবে পরে দেওয়ার কথা বললেও কুবের তা বিশ্বাসই করতে চায় না। শেষ পর্যন্ত সে শীতলবাবুকে ‘হালা ডাকাইত’ বলে খুবই আপত্তিকর গালি দেয়! নায়ক হিসেবে এমনটা করা মোটেও উচিত হয়নি! নায়কের ভাষা হবে মার্জিত। আর যা-ই হোক, সে কখনো কাউকে ‘হালা ডাকাইত’ বলে বিশ্রীভাবে গালি দেবে না। এ ক্ষেত্রে তার বরং বলা উচিত ছিল, ‘আচ্ছা গো শীতলবাবু, পরেই দিয়েন!’
‘বখাটে’ কুবের
পঙ্গু স্ত্রী মালার প্রতি কুবেরের যথেষ্ট সহমর্মিতা থাকা সত্ত্বেও সে মালার বোন কপিলার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে! এ জন্য কুবেরকে একা দুষলে অবশ্য অবিচার হবে। কেননা, কপিলাও ফাজিলের ফাজিল একটা! কিন্তু কুবের তো নায়ক। সে কাত হয়ে যাবে কেন? উপন্যাসের একপর্যায়ে দেখা যায় মেলা থেকে ফেরার পথে রাতের আঁধারে সুযোগ বুঝে কুবের কপিলার শাড়ি ধরে টান দেয়। একজন নায়কের পক্ষে এ ধরনের কথা চিন্তা করতেও তো গায়ে কাঁটা দেয়! এ আচরণ সুস্পষ্ট বখাটেপনা! খুবই অনায়কোচিত। উপন্যাসের একেবারে শেষদিকে হোসেন মিয়ার ময়না দ্বীপে যাওয়ার সময় কপিলা কুবেরকে বলে, ‘আমারে নিবা মাঝি লগে?’ আর কুবেরটাও যা! সে-ও যেন এর জন্যই বসে ছিল। এ ধরনের ‘লুজ ক্যারেক্টার’ মোটেও একজন নায়কের সঙ্গে যায় না!
উপসংহার
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে নায়ক হিসেবে কুবের চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ! নায়কোচিত কোনো গুণ তো তার মধ্যে নেই-ই বরং আউল-ফাউল টাইপের দোষে তার চরিত্রটি দুষ্ট! আবহমান বাংলার চিরায়ত ‘নায়ক’ চরিত্রটিকেই কুবের কলুষিত করে দিয়েছে!