কেমন আছেন প্রেমের আইকনরা?

প্রেম-ভালোবাসায় ‘আইকন’ চরিত্র লাইলি-মজনু, রোমিও-জুলিয়েট কিংবা বনলতা সেন। এই ভ্যালেন্টাইনস ডের রমরমার যুগে কেমন আছেন তাঁরা? শুনুন তাঁদের মুখেই!

আঁকা: আসিফুর রহমান
আঁকা: আসিফুর রহমান

লাইলি
শোনো, একটা কথা তোমাদের বলে রাখি, আমাকে এ নামে আর ডাকবে না। লাইলি বলো আর লায়লা বলো, নামটার মধ্যে কেমন একটা পুরোনো খ্যাত্ খ্যাত্ ভাব আছে। নায়লাও চলত, কিন্তু এই পরিচয় দিলেই মানুষজন বলে ওঠে, ‘ও, আপনিই নায়লা নাঈম?’ তারপরেই তারা তাদের দাঁতের সমস্যা নিয়ে আলাপ শুরু করে! আমার আর কাজ নেই যে মানুষজনের দাঁত দেখতে থাকি! অতএব আমি নাম চেঞ্জ করবই করব! তোমরা ফেসবুকে ইনবক্স করে আমাকে নাম সাজেস্ট করো! আরেকটা কথা, আমি যে মাঝেমধ্যে সেলফি আপ করি, তাতে আমার কথা জিজ্ঞেস না করে কেন শুধু মজনুর খোঁজ নাও তোমরা? মজনু বড়, না আমি? ওই লোক কাকে ভালোবেসে ‘মজনু’ হয়েছে? তা ছাড়া মজনু এখন একটা খ্যাত্। ময়লা জামাকাপড়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তার আশপাশে গেলেই নাকি বোঁটকা গন্ধ ভেসে আসে। এ জন্য তার সঙ্গে আমি দেখাই করি না। এবার ভ্যালেন্টাইনস ডেতে মজনুকে একটা পারফিউম গিফট করব বলে ঠিক করেছি। তোমরা ইনবক্সে ভালো কোনো পারফিউমের নামও সাজেস্ট করতে পারো। মজনু যদি ময়লা কাপড়চোপড় না ছাড়ে, পারফিউম-টারফিউম না ধরে, তাহলে বলব, তুই দূরে গিয়া মর! এ রকম গন্ধরাজ নিয়ে আর ভালো লাগে না আমার!

আঁকা: আসিফুর রহমান
আঁকা: আসিফুর রহমান

মজনু
কী আর খোঁজ দেব ভাই, কী আর খবর দেব? কখনো কারওয়ান বাজারে ঘুরি, কখনো ঘুরি গুলিস্তানে! বাসে-রিকশায় কেউ ওঠায় না। বলে, ‘এই পথের ফকিররে পথেই রাখো!’ লাইলির বাসা সেই বারিধারায়—সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে যায়। সিকিউরিটি গার্ড ধরে চড়-থাপড় মেরে পরিচয় জানতে চায়! যখন বলি, ‘আমি মজনু...’ ওরা খ্যাকখ্যাক করে হাসে। বলে, ‘এই দুনিয়ার সব ব্যাটাই তো মজনু!’ বলেন আপনারা, সব মজনু আর আমি মজনু এক হলাম? আমাকে দিয়েই না এই মজনু ট্র্যাডিশন শুরু! দাড়ি কাটার পয়সা নাই, চুল থাকে সব সময় উষ্কখুষ্ক! এ নিয়ে লাইলি আমাকে প্রায়ই খোঁটা দেয়। বলে এক্সিকিউটিভ কোনো জব খুঁজতে! ভাই বলেন তো, স্যুট-টাই পরে অফিস করা লোক কি কখনো মজনু হতে পারে? লাইলি বোঝে না। আমাদের প্রেমটা বোধ হয় আর টিকবে না...অমর প্রেম এবার মর-মর! মনে মনে সারাক্ষণ প্রার্থনা করি, যেন প্রেমটা না ভাঙে। এর মধ্যে ‘হিরোঞ্চি’ ভেবে পুলিশ পাঁচ-ছয়বার ধরেছে। তারপর কী করেছে, সে কথা না বলাই ভালো। যা হোক ভাই, এই মজনুর জন্য আপনারাও একটু দোয়া কইরেন। লাইলি যেন আবার আমাকে গেয়ে শোনায়, ‘লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া, মজনু গো আঁখি খোলো...!’

আঁকা: আসিফুর রহমান
আঁকা: আসিফুর রহমান

বনলতা সেন
আমি জীবনে মাত্র তিনজনকে বলেছি, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’
একজন ছিলেন দুধওয়ালা। প্রতিদিন সকালে দুধ দিয়ে যেতেন বাসায়। হঠাৎ একটা সপ্তাহ তিনি ডুব মারলেন। দুধের কষ্টে বাসায় চা পর্যন্ত হয় না। তারপর এক সকালে তিনি এসে উপস্থিত। আমি তাকে রাগ করেই বলেছিলাম, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’ দুধওয়ালা কোনো উত্তর দেননি।
আরেকজন ছিলেন ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রেতা। বেদের মেয়ে জোছনা সিনেমাটা দেখতে গিয়েছি বান্ধবীদের সঙ্গে। কিন্তু হাউসফুল। কোথাও কোনো টিকিট নাই। ওদিকে সিনেমা শুরু হয়ে যাচ্ছে! আমাদের মন-মেজাজ খুবই খারাপ। সে সময় টিকিট বিক্রেতা এসে পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘টিকিট লাগবে, টিকিট?’ আমি এত আনন্দিত হয়েছিলাম যে তাঁর হাত ধরে বলেছিলাম, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’
আরেকবার বাজার করে ফিরছি। প্রখর খরতাপ। ঘামছি। এর মধ্যে আমার স্যান্ডেল গেল ছিঁড়ে। চারপাশে কত মানুষ। কিন্তু একটাও মুচি নাই। কী করে কী করব বুঝতে পারছি না। তখন এক রিকশাওয়ালা এসে বললেন, ‘আফা, ওঠেন, আপনারে তো চিনি! আপনি সেনবাড়ির বনলতা সেন না?’
আমি রিকশায় উঠতে উঠতে বললাম, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’
আমি এখন সারাটা দিন ভাবি যে ওই তিনজনের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ কোনজন? একবার যদি তাঁকে হাতের কাছে পেতাম, তাহলে বোঝাতাম! লোকটা বলে কিনা, আমার চোখ নাকি ‘পাখির নীড়ের মতো’! এটার মানে কী? আমার চোখের ভেতর পাখি বাস করে? ডিম পাড়ে? আমার ববকাট চুল; সে চুল দেখে ওই লোক বলে, ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার...’ অন্ধকারের দেখেছে কী সে? আমার সঙ্গে দেখা হলেই চোখে অন্ধকার আর সরষে ফুল—সবই দেখবে! আর মুখ নাকি শ্রাবস্তির কারুকার্য? কনে দেখতে আসা এক স্থপতি বলেন, ‘আমরা তো কবিতা পড়ে আসছি...কই কনের মুখে তো তেমন কোনো শ্রাবস্তি-ফস্তি নাই!’
ওই জীবনানন্দ আমার জীবন থেকে সব আনন্দ নিয়ে পালিয়ে আছেন। একবার যদি আমি তাঁকে পাই, তাহলে সত্যি সত্যিই জিজ্ঞেস করতাম, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’ তারপর তাঁর এমন ব্যবস্থা করতাম যে হাজার বছর ধরে হাঁটা নয়, পুরোপুরি দৌড়ানির ওপর থাকতেন!

আঁকা: আসিফুর রহমান
আঁকা: আসিফুর রহমান

রোমিও
ওহ্ ম্যান! আমার জীবনের সাথে...ওই যে একটা পুরোনো গান আছে না...আরে ওই যে...প্রেম একবার এসেছিল নীরবে...বুল শিট! কী লাইফ! সারা জীবনে ওই একটা প্রেমই এলো, ম্যান! জুলিয়েট! এইটা কিছু হইল! একটা প্রেম আর সেইটাতেই হাবুডুবু খাইলাম নাকি আমি! এমন অবিচার লাইফের ওপর! একবার যদি আমি শেক্সপিয়ারটারে পাইতাম...বুঝায়া দিতাম এই অবিচার করার কী পরিণাম! প্রতি সন্ধ্যায় মই লাগায়া জুলিয়েটের বাসার ঝুলবারান্দায় উঠতে উঠতে লাইফটা হেল হয়ে গেল, ম্যান। সেই দিন তো বারান্দায় উঠতে গিয়া ইলেকট্রিক তারে শকও খাইছি! খাম্বা ধরে ঝুলে না পড়লে পাশের ঝিলে গিয়া হাপুস হইতাম! পরের তিনটা দিন শুধু মাথা ঝিমঝিম করছে! লাইক আমি ড্রাগস নিছি! আমার বন্ধুবান্ধব, ইয়ার-দোস্ত সবার এখন তিনটা–চারটা জিএফ...আর আমার? মাত্র একটা প্রেম নিয়া কঠিন প্যারায় আছি, ব্রো! সোসাইটিতে আর মুখ দেখান যাইতেছে না! ভাবছি শেক্সপিয়ারের বিরুদ্ধে একটা কঠিন মানববন্ধন করব! তোমরা সবাই আছ তো আমার সঙ্গে?

আঁকা: আসিফুর রহমান
আঁকা: আসিফুর রহমান

জুলিয়েট
রোমিও এখন যেন হোমিওপ্যাথি ওষুধ। তার প্রেমের ডায়ালগে আর সেই ধার নাই। তবে তার ছটফটানি বাড়ছে ইদানীং। পালায় পালায় বেড়ায়। কিন্তু লাভ নাই। ব্রাদার শেক্সপিয়ার তাকে এমন টাইট দিয়া রাখছে যে তাকে সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় আমার সাথে দেখা করতে আসতেই হয়। কিন্তু আর কত? এখন সময় অ্যালোপেথিকের। ধর তক্তা মার পেরেক! আমাদের প্রেমে তাই টুইস্ট দরকার। টুইস্ট হিসেবে ট্রায়াঙ্গল লাভ বেস্ট। তাই নতুন মুখ খুঁজছি। ভাবছি একটা বিজ্ঞাপনও দেব পত্রিকায়—কে হবে নতুন রোমিও?
ওদিকে সিনেমা থেকে অফার আসছে। সিনেমার নাম—হানড্রেড পার্সেন্ট লাফ! যৌথ প্রযোজনার এই ছবিতে আমিই শুধু এই দেশের। মানে আমাকে ছাড়া প্রযোজনাটা যৌথ হবে না। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা রোল, সেটাতে অভিনয় করব না? কিন্তু রোমিও খালি প্যানপ্যান করে। বেশি ইয়ে করলে ওর সাথে ব্রেকআপে যাব! ব্রেকআপ করে হানড্রেড পারসেন্ট লাফ দিয়ে সিনেমায় চলে যাব! তখন আমার ভালোবাসাও হবে যৌথ প্রযোজনার!