খেলাঘর

খেলাঘর
খেলাঘর

আমি ঝুপড়ি দোকানের ছেলেটাকে অকারণেই একটা ধমক দিয়ে বললাম, ‘এক কাপ চা দে!’ ছেলেটা আমার ধমকের পাত্তাই দিল না, সে দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘খালি চা খাইবেন ছার, নাশতা খাইবেন না?’
আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল। আদালত এলাকায় মামলার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে এমনিতেই আধমরা থাকি, তার ওপর কেউ অর্থহীন কথা বললে মেজাজ সামলানো কঠিন হয়ে যায়। আমি কড়া একটা ধমক দেওয়ার জন্য ছেলেটার দিকে তাকিয়েই একটা ধাক্কা খেলাম। এই ছেলে চায়ের দোকানে চাকরি করছে কেন! এই ছেলের তো এখনো মায়ের কোল ছেড়ে নামারই সময় হয়নি। এই বয়সের ভালো কোনো ঘরের ছেলে একা একা বাথরুমে গেলেই মা-বাবা ভয়ে অস্থির হয়ে যাবেন, অথচ এ ব্যাটা এখানে রীতিমতো দৌড়ে দৌড়ে মানুষজনকে চা-নাশতা দিচ্ছে! আমি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম, ‘তোর নাম কী?’ ছেলেটাও হাসে, ‘আমার নাম মোহাম্মদ রাসেল।’ আমি হেসে ওকে বলি, ‘তোকে এখানে চাকরি দিয়েছে কে?’ ছেলেটা আমার কথায় মজা পেয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘আমাগো বাড়ি বাঁশখালী। আমার বাপ এইখানে চাকরিতে ঢুকায়া দিছে। আমার বাপও এইখানে থাকে, পানি টানে। পানি কবীর কইলে সবাই চিনে।’ আমি খানিকটা অবাক হই, ‘তোর মা বাধা দেয়নি? তোর তো বয়স পাঁচ-ছয় বছরের বেশি হওয়ার কথা না!’
ছেলেটা মনে হয় এমন আজব কথা জীবনে কখনো শোনেনি, ‘কোন মার কথা কইতাছেন! আসল মা নাকি সৎমা? সৎমা ঘরে থাকে, আসল মায়ের আরেক জায়গায় বিয়া হইয়া গেছে!’ ওর কথা শুনে আমার প্রচণ্ড বিরক্তি লাগে, ‘বাহ্, তোর বাপ তো দেখি খুব রোমান্টিক মানুষ! ছেলেমেয়েকে খাওয়াতে পারছে না, তার ওপর বিয়েও করেছে দুইটা!’ রাসেল হাসতে হাসতে বলল, ‘হুনতাছি এইডারেও ছাইড়া দিব, আরেকটা বিয়া করব!’ আমার ইচ্ছে হলো কষে একটা চড় মেরে ওর সব কটা দাঁত ফেলে দিই। বাপ একটার পর একটা বিয়ে করছে, আর এই ব্যাটার কথা শুনে মনে হচ্ছে জীবনে এর চেয়ে বেশি আনন্দের ঘটনা আর কিছু নেই! আমি চুপচাপ মন খারাপ করে বসে থাকি। মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের পেছনের ছাপরা দোকানটা ছেড়ে আমার উঠতে ইচ্ছা করে না। সব সময় চারপাশে এত মন খারাপ করিয়ে দেওয়া ঘটনার কথা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত। আমার আর মন খারাপ করতে ইচ্ছা করে না। তার চেয়ে বরং মজিদ চাচার কথা বলি।
মজিদ চাচা আইনজীবী এনেক্স ভবনের চতুর্থ তলার পরিচ্ছন্নতাকর্মী। সত্তরোর্ধ্ব এই বৃদ্ধকে সারা দিনই আমি ব্যস্ত দেখি। কখনো বাথরুম পরিষ্কার করছেন, কখনো মেঝে ঝাঁট দিচ্ছেন। আর সুযোগ পেলে বাথরুমের সামনে বসে থাকা তাঁর বৃদ্ধ স্ত্রীর সঙ্গে গুটুর গুটুর করে গল্প করছেন। একদিন সকালে মজিদ চাচাকে একা দেখে বললাম, ‘কী চাচা, আজকে চাচি আসে নাই?’ মজিদ চাচা একগাল হেসে বললেন, ‘দুপুর বেলা ভাত নিয়া আসবে।’ বৃদ্ধের কথা শুনে আমি রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। দুপুর বেলা দেখি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা একসঙ্গে বসে ভাত খাচ্ছেন। আমি একদিন বৃদ্ধাকে পাকড়াও করি, ‘চাচি, আপনি ভাত নিয়া আসেন কেন? ছেলেমেয়ে নাই? নাকি চাচাকে না দেখলে ভালো লাগে না?’ বৃদ্ধা হাসেন, ‘রান্ধনের পর আর কোনো কাজ থাকে না। তাই ভাত নিয়া আমিই চইলা আসি। সারা জীবন একসঙ্গে ভাত খাইতে খাইতে অভ্যাস হইয়া গেছে। চোখের সামনে না খাইলে আমারও পেট ভরে না।’ বৃদ্ধার কথা শুনে আমি হাসতে থাকি। এই সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা আমাকে অন্যরকম আনন্দের একটা জগতে পৌঁছে দেন। যখন আস্তে আস্তে দুপুরের কড়া রোদটা মরে গিয়ে শান্ত বিকেল নেমে আসে, তখন কেমন যেন একটা নিস্তব্দতা গ্রাস করে সমস্ত পৃথিবীকে। সারা দিনের ব্যস্ততা কাটিয়ে তখন বাথরুমের সামনে ছোট্ট জায়গাটাতে বসে গল্পে মাতেন এই দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। বৃদ্ধা আপন মনে পান বানাতে থাকেন আর তিন পেয়ে একটা ভাঙা চেয়ারে বসে মজিদ চাচা সেদিকে তাকিয়ে থাকেন মুগ্ধ চোখে। আমি তখন তাঁদের দেখার জন্য বারবার সেদিক দিয়ে হাঁটি, ঘন ঘন বাথরুমে যাই। বৃদ্ধা আমাকে দেখে বলেন, ‘ছার, কেমন আছেন?’ আমি লজ্জা পেয়ে বলি, ‘আমাকে স্যার ডাকেন কেন? আমি তো আপনাদের দেখার জন্যেই বারবার এদিকে আসি।’ আমার কথা শুনে দুজনেই লজ্জা পান। সেই রোদ্দুর চুরি করা বিকেলে এই দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে দেখে আমার একদম মনেই হয় না তাঁরা জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছেন। আমার কেন জানি মনে হতে থাকে, এখনো জীবনের কোনো কিছু না বোঝা দুটি শিশু একমনে পুতুল নিয়ে খেলছে। কিছুক্ষণ পর তাঁদের এই খেলাঘর ভেঙে দিয়ে দৌড়ে মিলিয়ে যাবে সন্ধ্যার অন্ধকারে।
জুয়েল দেব, চট্টগ্রাম