গোল কোরো না গোল কোরো না...

আঁকা: রাজীব
আঁকা: রাজীব

আমার বন্ধু শিহাব ফুটবলের খুব ভক্ত। ফুটবলের সঙ্গে দারুণ মিলও আছে ওর। দুটোই সম্পূর্ণ গোল। মাঝেমধ্যে শিহাবকে দেখলেই আমরা ‘গোওওল’ বলে চিৎকার করে উঠি (লাথিও মারতে চাই, সাহসে কুলায় না বলে শুধু চিৎকারেই সীমাবদ্ধ থাকি)। আশপাশের লোকজন চমকে এদিক–ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, খেলাটা আসলে হচ্ছে কোথায়! শিহাবের তাতে কিছু যায় আসে না। বিশ্বের কোন কোনায় কে ফুটবল খেলছে, তা নিয়ে তার যত চিন্তা! তবে ও যে প্রচণ্ড আশাবাদী একজন মানুষ, তা দেখে কেউ বুঝবে না। বুঝবে তখনই, যখন ও বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে কথা বলতে শুরু করবে। বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে তার অনেক আশা। নতুন কোচ এলেই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে রিপনের দোকানে আদা–চায়ের অর্ডার দেয় সে (অর্ডারটাই শুধু ও দেয়, বিলটা দিতে হয় আমাকেই)। নতুন কোচ যে কত ভালো এবং কীভাবে আমাদের ফুটবলকে তিনি বিশ্বমানচিত্রে জায়গা করিয়ে দেবে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে শিহাব। অবশ্য ওকে বেশ ঘন ঘনই খুশি হতে দেখা যায়। কারণ, ঋতু পরিবর্তনের মতোই কদিন পরপর পরিবর্তন হয় আমাদের ফুটবল দলের কোচ। বিদেশ থেকে যত ফুটবল কোচ আসেন, হাইওয়েতে চলার জন্য বোধহয় এত হিনো চেয়ারকোচ বাসও আসে না! এ কথা শুনে খুব খেপে যায় শিহাব, ‘গাধা! ফালতু কথা বলিস না। দেশের ফুটবলের কোনো খোঁজ রাখিস তুই? বল, আমাদের বর্তমান কোচের নাম বল।’

‘বর্তমান কোচ সেন্টফিট (যদিও তিনি এখন পর্যন্ত কোচ আছেন কি না তা নিয়ে আমি সন্দিহান)। সুদূর বেলজিয়াম থেকে আসা। তবে দোস্ত, কোচ তো ফিট, কিন্তু দলের খেলোয়াড়েরা কতটুকু ফিট, সেটা নিয়ে আলোচনা ওঠে মাঝেমধ্যেই। অনেকের অভিযোগ, ফুটবলাররা ঠিকমতো অনুশীলন করেন না। অনুশীলনে আসেন দেরিতে। এ বিষয়ে তোর কী মত?’

শিহাব আবারও খেপে হাতে কিল দিয়ে বলল, ‘তোরা তো অভিযোগ করেই বসে থাকিস। খেলোয়াড়েরা কেন দেরিতে অনুশীলনে আসেন, তা কি কোনো দিন ভেবে দেখেছিস?’

আমি মাথা নাড়ি। না তো। ভেবে দেখিনি। মিরপুরের বাস কেন দেরিতে আসেন, এটা নিয়েই আমি অধিকাংশ সময় ভাবি। অন্য কিছু ভাবার সুযোগ আর পেলাম কোথায়? শিহাব উত্তেজিত হয়ে হাত–মাথা নেড়ে বলতে লাগল, ‘একটু চিন্তা কর। ইউজ ইয়োর ব্রেইন, ম্যান! প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে ভালো করতে হলে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের খেলা দেখতে হবে। বুঝতে হবে। কিন্তু ফিফা ফ্রেন্ডলি, চ্যাম্পিয়নস লিগ, বুন্দেসলিগা, স্প্যানিশ লিগ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ এসবের অধিকাংশ খেলাই হয় গভীর রাতে। ফলে রাত জেগে খেলা দেখার কারণে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয় আমাদের ফুটবলারদের। তাই দেরি হয় অনুশীলনেও। শুধু শুধু ফুটবলারদের দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই।’

‘নাহ্‌। তঁাদের কোনো দোষ নেই। এ জন্যই তো পাঁচ গোল খেয়ে হাসিমুখে সেলফি আপলোড করেন।’

‘ঠিকই তো আছে। বইয়ে পড়িস নাই? যেকোনো বিপদ হাসিমুখে মোকাবিলা করতে হয়। এটা কয়জন পারে, বল? ব্রাজিল যে সাত গোল খেয়েছিল, তাদের কাউকে হাসতে দেখেছিস? তারা পারে না। তারা ওই বিপদটা হাসিমুখে মোকাবিলা করতে পারেনি। আমরা পারি।’

‘ও আচ্ছা। দারুণ বলেছিস। তাহলে বল, আমাদের ফুটবলারেরা গোল করতে পারেন না কেন? হালি হালি গোল খাই আমরা। ভুটানও আমাদের তিন গোল দেয়! এটা কোনো কথা? বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ৮ ম্যাচে ৩২টা গোল খেয়েছি! কেন? হোয়াই?’

‘এটারও খুব সহজ ব্যাখ্যা আছে। তোরা তো লেখাপড়া কিছু করিস না। করলে জানতি, বিখ্যাত কবি সুফিয়া কামাল আমাদের গোল করতে নিষেধ করে গেছেন।’

‘ফাজলামি করিস? তোকেই ফুটবল বানিয়ে লাথি মারব এবার। উনি কেন গোল করতে মানা করবেন?’

‘বললাম না, তোরা মূর্খ। জ্ঞানহীন! আরে সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ‘‌‘গোল কোরো না গোল কোরো না, ছোটন ঘুমায় খাটে’’। এত বড় একজন মহীয়সী কবির কথা আমরা অমান্য করব কীভাবে? এ জন্যই আমরা গোল করি না। বোঝো নাই ব্যাপারটা?’

‘বুঝছি। এই ছোটন কে তা জানিস?’

‘কে? আমাদের নিচতলার দারোয়ান ছোটন নাকি?’

‘জি না। এই ছোটন হচ্ছে আমাদের ফুটবল ফেডারেশন। আমরা দিনের পর দিন ম্যাচ হারছি। গোল খাচ্ছি। মানুষ দুধের স্বাদ ঘোলে মেটায়, আমরা মেটাচ্ছি গোলে। অথচ তারা ‘ছোটন’ হয়ে আরাম করে ঘুমাচ্ছে। নতুন খেলোয়াড় তুলে আনছে না। ঘরোয়া ফুটবলের অবস্থাও যাচ্ছেতাই।’

‘এহ্‌! নতুন খেলোয়াড় কি তোর বাড়ির পাশের খেতের আলু নাকি যে চাইলেই তুলে আনবি? ফেডারেশনের কী দোষ? তারা তো চেষ্টা করছেই। হবে একদিন। খেলোয়াড় আসবে।’

‘আসলেই। সব দোষ আমাদের।’

‘হ্যাঁ। তোদেরই তো দোষ। তোরা এত নৈরাশ্যবাদী কেন? ভুটানের কাছে তিন গোল খেয়েছি বলে তোদের ঘুম হচ্ছে না হতাশায়। কেন, আমরা যে একটা গোল দিলাম, সেটা দেখলি না?’

‘ব্যাটা, ভুটানকে আমরা বলেকয়ে হারাতাম আগে! এই প্রথম হারলাম! আর এই হারের কারণে যে আগামী তিন বছর ফিফা-এএফসির কোনো ম্যাচ পাব না, তার কী হবে? তবু তোর মতো খুশি হব আমরা?’

‘অবশ্যই খুশি হবি।’

‘কেন?’

‘কারণ, এই তিন বছর ফিফা বা এএফসির কোনো ম্যাচে আমরা হারব না। গোলও খাব না। এটাও কি বড় অর্জন নয়?’

আমার ধারণা, এ রকম বিপুল পরিমাণ ‘শিহাব’ আমাদের ফুটবল ফেডারেশনে ঘাপটি মেরে আছে। কিংবা কে জানে, হয়তো খেলোয়াড়দের মধ্যেও কোনোভাবে শিহাবীয় চেতনা ঢুকে গেছে। সে জন্যই একের পর এক পরাজয়ের পরও কেউ কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। তবে নিশ্চয়ই একদিন কেউ উদ্যোগ নেবে। এই রে, শিহাবের ভাইরাস কি আমার মধ্যেও ঢুকে গেল!