
এক বাগানে ২০০ গোলাপ মিলতেই পারে। কিন্তু ২০০ রকমের গোলাপ? দেখার মতো ব্যাপার তো বটেই। গোলাপবাগান দেখতে আগ্রহী হওয়ার কারণ আছে আরও। সেই ছেলেবেলায় পড়েছি শাহরিয়ার কবিরের বই কার্পেথিয়ানের কালো গোলাপ। বইয়ের কাহিনি পুরোপুরি মনে নেই। কিন্তু সেই থেকে আমার সত্যিকার কালো গোলাপ দেখার শখ। ২০০ ফুলের মধ্যে একটা কালো গোলাপ? আশা করতে দোষ কী?

গোলাপবাগানের খবরটা দিয়েছেন নাহিদ খান (মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির অবসরে ছুটির দিনের জন্যও লেখেন তিনি)। তখন ডিসেম্বরের শেষ। বড়দিনের ছুটির আমেজ অস্ট্রেলিয়াজুড়ে। সেই ছুটি কাজে লাগাতেই নাহিদ খান এবং মুনির আহমেদ খান দম্পতির সঙ্গে একদিন সোজা সেই গোলাপবাগানে। যার নাম ভিক্টোরিয়া স্টেট রোজ গার্ডেন।
বেলা দুপুর গড়িয়েছে অনেকক্ষণ। সূর্যের তাপ কমেনি। অস্ট্রেলিয়ায় মশার উৎপাত নেই। কিন্তু মাছির উৎপাত খুব বিশ্রী রকমের। দুই হাতে মাছি তাড়াতে তাড়াতে বাগানে ঢুকেই, ওরিব্বাস! এ যে সাক্ষাৎ গোলাপরাজ্য! লাল, হলুদ, গোলাপি, বেগুনি, সাদা— সব মিলিয়ে চারদিকে যেন রঙের ফুলঝুরি। গোলাপের নামও বাহারি। হানি ডিয়ন, অ্যাসপিরিন, গ্লোরিয়াস. অ্যাঞ্জেল ফেস, আরও কত কী!
গোলাপরাজ্যের সৌন্দর্য বাড়াতেই বুঝি বাগানে এসে জুটেছে বাচ্চাকাচ্চাদের দল। গোলাপঝাড়ের আড়ালে লুকোচুরি খেলতে লেগে গেছে তারা। বড়রা ছবি তুলে যাচ্ছে একের পর এক। বড় ভাবি সালমা শফিকের হাত ধরে ছিল নাজিফা।

মওকা বুঝে মায়ের হাত ছেড়ে সে চট করে মিশে গেল গোলাপবাগানে। আমরাও একের পর এক ছবি তুলতে শুরু করি।
‘তোমাদের ভাগ্য ভালো। আনিসুজ্জামান (অধ্যাপক আনিসুজ্জামান) স্যারকে একবার নিয়ে এসেছিলাম এই বাগানে। এসে দেখি সাড়ে সর্বনাশ! একটা গোলাপগাছও অবশিষ্ট নেই। পুরো বাগানটা একদম ন্যাড়া। কী লজ্জার ব্যাপার!’
নাহিদ খান বলছিলেন এক কৃতী বাঙালির এই গোলাপবাগান দর্শনের গল্প। সে দফায় না হলেও সদ্য পদ্মভূষণ বিজয়ী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান নাকি পরের দফায় সস্ত্রীক এই গোলাপবাগান দেখে যেতে ভোলেননি। প্রায় প্রতিবছর মেলবোর্ন বাংলা সাহিত্য সংসদ আমন্ত্র্রণ জানায় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের। সে সুবাদে তাঁদের অনেকেই এই বাগান ঘুরে গেছেন।

ছয় একরজুড়ে এই গোলাপরাজ্য। প্রবেশপথে সেঁটে দেওয়া মানচিত্রই বলে দিচ্ছে, বাগানের আকারটাও অবিশ্বাস্যভাবে গোলাপের মতোই। ওপর থেকে দেখলে মনে হবে, ঠিক যেন একটা গোলাপ ফুল, পাপড়ি মেলে আছে। বাগানের ওয়েবসাইট বলছে, ভিক্টোরিয়া স্টেট রোজ গার্ডেনে গোলাপের সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। ১৯৮৬ সালে তৈরি হওয়া এই বাগান এরই মধ্যে পেয়েছে ইন্টারন্যাশনাল গার্ডেন অব এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড। পুরস্কারটা দেয় নাকি ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব রোজ সোসাইটিজ, বাংলায় বলা যায় বিশ্ব গোলাপ সংঘ। দুনিয়াজোড়া শত-সহস্র ফুলের মাঝে গোলাপই নিঃসন্দেহে অধিক পরিচিত আর প্রিয়তর। আর সম্ভ্রান্ত তো বটেই। প্রিয়ার হাতের যে ফুলটির জন্য দুনিয়া খানখান হতে পারে, সেটি অবশ্যই গোলাপ। শুধু গোলাপ নিয়ে এমন বড় একটা বাগান করার এই ভাবনাও নিশ্চয়ই গোলাপের প্রতি সেই ভালোবাসা থেকেই।

ভিক্টোরিয়া স্টেট গার্ডেন চলে মূলত স্বেচ্ছাসেবীদের সেবায়। সকাল সাড়ে নয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বছরের প্রায় দিনই খোলা থাকে এই বাগান। পুরো বাগান ঘুরে দেখতে গেলে ঘণ্টা খানেকের মতো সময় লেগেই যায়। বাগানের এমাথা-ওমাথা ঘুরছি। ব্যতিক্রমী রঙের গোলাপ দেখলেই ফটাফট ছবি ওঠাচ্ছি। এক লাল গোলাপেরই দেখছি হরেক রূপ। একই ব্যাপার হলুদ-গোলাপের বেলায়ও। অতি উচ্চ আর বিরল বংশের বহু গোলাপের দেখা মিলল। সেগুলোর ছবিও ওঠানো গেল। কিন্তু কালো গোলাপ কই?
তন্ন তন্ন করে পুরো বাগান ঘুরেও কালো গোলাপের দেখা মিলল না। এত বড় বাগানে একটাও কালো গোলাপ নেই? কোনো মানে হয়? মুনির আহমেদ খান সম্ভবত আমার হতাশাটা ধরতে পেরেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘদিন। বলতে গেলে আমার শিক্ষকই। তাঁকে কি বলব কথাটা? থাক। কালো গোলাপের হতাশা নিয়ে আমরা বাগান ছাড়ি।
পরে কালো গোলাপ রহস্য ভেদ করতে ইন্টারনেটে খোঁজ। রহস্য ভেদ করতে দেরি হলো না। উইকিপিডিয়া বলছে, কালো গোলাপ আসলে অনেক ক্ষেত্রেই প্রতীকী বা রূপক একটা ব্যাপার। অনেক জায়গায় কালো বা কালচে দেখতে গোলাপ হয় বটে, সেটা আসলে গভীর লাল, খয়েরি আর বেগুনি রঙেরই কারসাজি! কার্পেথিয়ানের কালো গোলাপ বইটা তাহলে আরেকবার পড়া দরকার।


