টেডিবিয়ার

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মা আর বাবাকে নিয়ে আমাদের সাজানো-গোছানো ছোট্ট পরিবার। সংসারের প্রতিটি জিনিসই সাধারণত মায়েরাই গুছিয়ে থাকেন, ঘরটাকে তারাই সাজান। কিন্তু আমার মায়ের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। আমাদের ঘরটা মার হাতে না সাজলেও মা যেভাবে চেয়েছিল, যেভাবে সাজাতে বলেছিল, আমি ঠিক সেভাবেই গোছানোর চেষ্টা করেছি। ঘরের সব জিনিসের মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দের জিনিস হলো দুটো হাত ধরাধরি ‘টেডিবিয়ার’, যেটির একটি মেয়ে, অন্যটি ছেলে। যদিও আগে আমি ওই জিনিসকে মোটেই পছন্দ করতাম না। আমার কাছে ওটা ছিল অনেক বেশি আজব। মেয়ে টেডিটার আবার দুটো চোখ নেই। আজব তো! এই রকম একটা নষ্ট জিনিস ফেলে দেওয়াই তো ভালো। আম্মুকে বললে মা কিছুতেই ওটা ফেলতে চাইত না। আম্মুকে ওটা ফেলতে বললে শুধু ‘ফেলিস না’ বলত, কেন ফেলব না তা কখনো বলত না। মাকে অনেক চাপাচাপি করলে বা ‘প্লিজ’ ‘প্লিজ’ বললেও মা কিছুই বলত না। আমি একদিন ইচ্ছা করে আম্মু যখন গোসলে, তখন জোরে জোরে বললাম, ‘টেডি, এবার আর যাবি কোথায়? তোদের জানালা থেকে, জা-না-লা থেকে ফেলব।’ হঠাৎ দেখি আম্মু কোনো রকম কাপড় পরে দৌড়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে চিৎকার করে বলছে, ‘এই প্রভা, ওটাকে ফেলবি না।’ ‘তাহলে এটার কাহিনি বলো’—আমার তাৎক্ষণিক জবাব। পাশেই দেখি বাবা। অফিস থেকে এসে আমাদের সব কর্মকাণ্ড দেখে হাসছে।
বাবা বলল, ‘আমার কাছে আয় আমি বলব।’ আম্মু অনেকবার নিষেধ করলেও বাবা বলে, ‘আমি না হয় এখন বুড়ো, তার পরও কোনো সময় তো আমি রোমান্টিক ছিলাম, তোমার মেয়েও তা জানুক!’
তারপর বাবা বলতে লাগল, ‘তোর মা আর আমি একই ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম। তোর মাকে ভালো লাগার আগে আমার ওর দুইটা চোখ অনেক ভালো লেগেছিল, পুরো ক্যাটস আই, মানে কটা চোখ। তোর মায়ের চোখের বর্ণনা দিয়ে আমি কবিতাও লিখেছিলাম, সেটা তোর মাকে দিতে গিয়ে কীভাবে যেন একটা বদমেজাজি ম্যাডামের কাছে চলে যায়।’ ওই ম্যাডাম তোমাকে কিছু বলেনি বাবা?
‘আরে বলছি, ওই ম্যাডাম ভেবেছিল আমি তার চোখের বর্ণনা দিয়েছি, কারণ তার চোখও ছিল ক্যাটস আই। ম্যাডাম আমাকে বকা না দিয়ে মুচকি হেসে বললেন, “ভেরি নটি, সামাদ!” আমি তো পুরো হাঁ হয়ে গেলাম, কাকে দিলাম আর কে পেল! তোর মা খুবই চালাক। ঠিকই বুঝেছিল আমি তাকে কবিতা লিখেছিলাম, কিন্তু উনার ভাবখানা এমন, “থাক তুমি ওই মহিলার সাথে”!’
‘তারপর?’
‘তারপর তোর মাকে আমি যেদিন প্রপোজ করলাম, সেদিন একটু হলেও বুঝেছিলাম, সেও আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু কিছু একটা বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। আমাকে শুধু এটুকুন বলল, “আমার চোখ আগে ছিল কালো, পরে আস্তে আস্তে ছাই, আর শেষে চোখে কোনো রং থাকবে কি না জানি না”। এই কথাটা নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করে এর কোনো অর্থ না পেয়ে পরের দিন ওর কাছেই জিজ্ঞেস করি। ও বলে, “ডাক্তার বলেছে আমার চোখে এমন একটা ছানি পড়েছে, যেটা কোনো চিকিৎসায় ঠিক হবে না। আর আমি আস্তে আস্তে দৃষ্টিহীন হয়ে যাব, ঠিক সামনের ওই ভিক্ষা করতে আসা অন্ধ লোকটার মতো। ওই লোকটার হাতের ছড়িটার মতো আমারও ছড়ি অবলম্বন করেই পথ চলতে হবে”।’
‘পরেরটা আমি বলি?’ আমার মা বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম এই কথাটা শুনে তোর বাবা আর কখনোই আমার কাছে আসবে না। কিন্তু...’
‘কিন্তু কী মা?’
‘দেখি তোর বাবা আমাকে ওই হাত ধরা টেডিবিয়ারটা দিল, যেটার মধ্যে মেয়ে টেডিটার দুইটা চোখ ছিল না। ওটা দিয়ে তোর বাবা আমাকে বলল, “এই ছেলে টেডিটা যেমন ওর সঙ্গী অন্ধ হলেও ওর হাত ধরে রেখেছে, আমিও তোমার হাত এভাবেই সারা জীবন ধরে রাখতে চাই”।’
বাবা বলল, ‘প্রপোজও করেছি এমন এক দিনে, যেদিন না করতে পারবে না। হ্যাঁ, না বলে যায় কোথায়?’ বাবার কথাগুলোর শেষে দেখি বাবা মায়ের হাত ঠিক ওই ছেলে টেডিটার মতো ধরল, ‘আমি কি আমার কথা রাখতে পেরেছি?’ বাবার এই প্রশ্নে মায়ের গাল মনে হয় একটু লাল হয়ে এসেছিল, ঠিক যেমন ওই মেয়ে টেডিটার গালে একটু লাল ছিল।
নোশিন শারমিলি
ঢাকা