
আচ্ছা, রামেন্দুদা কি চিরকালই মুগ্ধ শ্রোতা? কথা যা বলার তা বলেন ফেরদৌসী আপা?
তাঁদের দুজনের সঙ্গেই কথা বলতে গিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু ৫২ মিনিট কথা বলার পর যখন রেকর্ডারে কথা শোনার পালা, দেখি, সেখানে প্রায় ৪৮ মিনিটই কথা বলেছেন ফেরদৌসী মজুমদার! রামেন্দু মজুমদার কথা শুরু করলেও তা রিলে রেসের মতো টেনে নিয়ে গেছেন তাঁর সহধর্মিণী। শেষ পর্যন্ত ফেরদৌসী আপাই বললেন, ‘রেকর্ড করা বন্ধ করো, না হলে কথা শেষ হবে না।’
এই ফেরদৌসী আপারই একসময় গলা বসে গিয়েছিল—তাঁর স্বর্ণযুগে। তিনি তো ভেবে বসেছিলেন, গলায় ক্যানসার হয়েছে। চিকিৎসক পরীক্ষা করে বললেন, না, ওসব কিছু না। গলায় চাপ পড়ছে। মহড়া শেষে বাড়ি ফিরে আর কথা বলবেন না।
কী বলছেন চিকিৎসক! কিন্তু মঞ্চের ডাকসাইটে অভিনেত্রীকেও তো চিকিৎসকের পরামর্শ মানতে হয়, তাই রফা হলো তালি দিয়ে তিনি যাকে দরকার তাকে ডাকবেন। এক তালি দিলে আসবে নূরী, দুই তালি দিলে জ্যোৎস্না, তিন তালি দিলে...তখন রামেন্দু মজুমদার বললেন, ‘আমি আসব কয় তালি দিলে?’
ফেরদৌসী মজুমদার বললেন, ‘তোমার আসতে হবে না। আমিই তোমার কাছে যাব।’
১৮ জুন সত্তরে পড়লেন ফেরদৌসী মজুমদার। কিন্তু কথা আর হাসির ছন্দে তিনি জানিয়ে দিচ্ছেন, এটা কোনো বয়সই নয়। রামেন্দুদাও বললেন, ‘আসলে এখনো সারা দিন এত কাজ করতে হয় যে কোন দিক দিয়ে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, সেটা বুঝতেই পারি না। ও হয়তো একটু একাকিত্বে ভোগে।’ (রামেন্দু মজুমদার ফেরদৌসী মজুমদারের চেয়ে বছর দেড়েকের বড়)।
কথা টেনে নেন ফেরদৌসী মজুমদার। ‘হ্যাঁ, তোমাদের দাদা সেই যে সকাল নয়টায় ঘর থেকে বের হয়, ফেরে রাতে। আমি তো বলি, বাইরে যদি কোনো বিছানার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে সে আর বাড়ি ফিরত না।’ বলেই তাঁর ঘর কাঁপানো হাসি। রামেন্দু মজুমদারের ঠোঁটের কোণে যার দেখা মিলল, সেটাকেও অবশ্য হাসিই বলে, তবে তাতে সস্নেহ ভালোবাসাও দৃশ্যমান।
১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন দুজনেই। ফেরদৌসী বাংলায়, রামেন্দু ইংরেজিতে। সাবসিডিয়ারি ছিল সমাজবিজ্ঞান। সেখানেই দেখা-সাক্ষাৎ হতো। ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমীর নাট্যমৌসুমে রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকটি করেছিলেন তাঁরা। মুনীর চৌধুরীর নির্দেশনায়। ঢাকায় যখন টেলিভিশন অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হলো, তখনো তাঁরা দুজন মুনীর চৌধুরীর একতলা দোতলা নাটকটি করেছেন। এটি ছিল ঢাকা কেন্দ্রের (এখনকার বিটিভি) প্রথম নাটক।
এবার প্রশ্নটা করতেই হয়। ‘আপনারা কখন বুঝতে পারলেন, একই ছাদের নিচে থাকতে হবে?’
রামেন্দুদাই জানালেন, ১৯৬৫ সালে পড়াশোনার পাট চোকার পর থেকেই আসলে ভাবনাটা জোরালো হয়েছিল। তবে বিয়ে হয়েছিল ১৯৭০ সালে।
এর মধ্যে নাটক নিয়ে অনেক কথা হতে থাকে। সেই যে মুক্তিযুদ্ধের পর থিয়েটার গড়ে তোলা, থিয়েটারের জন্য আবদুল্লাহ আল মামুনের একের পর এক নাটক লিখে চলা, তিন টাকা দামের টিকিট বিক্রির জন্য বাড়ি বাড়ি যাওয়া—আরও কত প্রসঙ্গই তো উঠে এল। কিন্তু আমরা এবার এই দম্পতিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম মঞ্চের বাইরে। জন্মদিনের প্রসঙ্গ তো আর বাদ যায় না। দুজনেই জানিয়ে দিলেন, ঘটা করে জন্মদিন পালন তাঁদের ভালো লাগে না। তা ছাড়া পালন করা হলেই মনে হয়, বয়স বেড়ে গেল।
তবে একটি স্মৃতির কথা বলতে ভুললেন না ফেরদৌসী মজুমদার। ‘আমার মেয়ে ত্রপার জন্মও হয়েছে আমারই জন্মদিনে। তো একবার ১৮ জুন রাত ১২টা এক মিনিটে এই বাড়িরই প্যাসেজ দিয়ে দৌড়ে আসছিল ত্রপা। আমিও যাচ্ছিলাম ওর ঘরের দিকে। প্যাসেজেই আমাদের মধ্যে ঠোকাঠুকি। “মা, তুমি কোথায় যাও? আমি তো তোমার জন্য একটা জিনিস নিয়ে এসেছি।” ত্রপা জানায়।’
‘আমরা জন্মদিনে বাইরে খাই। মূলত চীনা খাবার। ফেরদৌসীর কিন্তু বাইরের খাবারই বেশি পছন্দ!’ জানালেন রামেন্দু মজুমদার।
কথা কেড়ে নিয়ে ফেরদৌসী বলেন, ‘একবার গেছি বিলেতে। রাতে খেয়ে ফিরেছি। যে বাড়িতে উঠেছিলাম, সে বাড়ির গৃহিণী তো খুব খেপেছেন। কেন বাইরে খেয়ে এসেছি। জিজ্ঞেস করলাম, কী রান্না করেছেন? বললেন, লাউ। বললাম, লন্ডনে এসেছি কি লাউ খেতে? স্যান্ডউইচ, পাস্তা—এগুলো খাব এখানে। দেশের খাবার তো দেশেই খাই।’ বলেই আবার হো হো হাসি। হাসির দমক থামলে বললেন, ‘রেস্তোরাঁয় গিয়ে কেন কই মাছ, চিংড়ি মাছের মালাইকারি খাব? এগুলো তো বাড়িতে নিজে রান্না করে খাব। চীনা রেস্তোরাঁয় গেলে শ্রিম্প টোস্ট, বোনলেস চিকেন ভালো লাগে। স্যুপ খেতে চাই না। স্যুপ খেলে পেট ভরে যায়। তাই আমি মেইন ডিশটাই নিই। স্যুপ পছন্দ করে ও।’—বলে রামেন্দু মজুমদারকে দেখিয়ে দিলেন।
ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠেন ফেরদৌসী মজুমদার। স্কুলে পড়ান, তাই আজ কী পড়াবেন সেটা ঠিক করে ফেলেন। নাশতা কী হবে তার পরামর্শ দেন। এরই মধ্যে রামেন্দু মজুমদার ঘুম থেকে উঠে টেলিভিশনে তারা মিউজিক ছেড়ে দেন, চা হাতে পত্রিকা পড়েন। ফেরদৌসী মাঝে মাঝে সে ঘরে আসেন, তবে বসেন না। বসলেই অন্য কাজ আর হবে না। তারপর দুজনেই বেরিয়ে পড়েন যে যাঁর কাজে।
১৯ জুন ফেরদৌসীকে নিয়ে একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হচ্ছে। তাতে তাঁর নাটক, পারিবারিক জীবন নিয়ে অনেক কিছুই থাকবে। রামেন্দু মজুমদারকে নিয়েও একটি বই বেরিয়েছে এ বছরই: দীপ্তিময় ৭০ রামেন্দু মজুমদার।
বলেছিলাম, আপনাদের দুজনেরই তো সত্তর হলো...
রামেন্দুদা চোখ-মুখ গম্ভীর করেই বললেন, ‘হুম, দুজনের মিলে ১৪০।’
সে কথায় ফেরদৌসী মজুমদারের দম ফাটানো হাসি যেন আর শেষ হতে চায় না।