দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি

.
.

সুঠামদেহী মোরগ জাম্বু হঠাৎ আবিষ্কার করল, যে তেলাপোকাটা সে অনেকক্ষণ ধরে খাওয়ার চেষ্টা করছে, তা আসলে প্লাস্টিকের তৈরি। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল তার। মাথা নুইয়ে খাবারের খোঁজ করতে যাবে, এমন সময় সে দেখল, একটা সাদা রঙের মুরগি দৌড়ে আসছে। ঝুঁটিটা একটু নাড়িয়ে বেশ ভাব নিয়ে মুরগিটার পথ রোধ করল জাম্বু। আচমকা ওকে দেখে যেন ব্রেক কষল দৌড়াতে থাকা মুরগিটা। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘কী ব্যাপার ভাই? পথ আটকালেন যে?’
মুরগিটার কথা শুনে হতাশ হলো জাম্বু। এ তো ফার্মের মুরগি। ধুর, এদের সঙ্গে কথা বলে কোনো মজা আছে! তাচ্ছিল্যের সুরে বলল সে, ‘আরে, এ তো দেখি ফার্মের মুরগি!’
: তো তুমি কী?
গলা খাঁকারি দিয়ে জাম্বু বলল, ‘আমি একজন সম্ভ্রান্ত দেশি মুরগি।’
: শোনো, জন্মসূত্রে তুমি যেমন দেশি, আমিও তাই। অযথা এই সব জাতিভেদ নিয়ে আসবে না তো। সরো। আমরা মুরগি, এটাই বড় পরিচয়।
জাম্বুকে কোনো কথা বলতে না দিয়েই ছুটল ফার্মের মুরগিটা। জাম্বু তো অবাক! কথায় যুক্তি আছে। তার মতো ওই মুরগিটাও তো দেশি। ফার্মের মুরগি যে এত চমত্কার চিন্তা করতে পারে, তা সে কখনো ভাবেনি। জাম্বুও ছুটল মুরগিটার পেছনে।
: ইয়ে, জগিং করছ নাকি?
মুরগিটা থেমে বড় করে দম নিয়ে বলল, ‘জি না। আমি খামার থেকে পালিয়েছি!’
: কী! এ তো অসম্ভব!
: অসম্ভবকে সম্ভব করাই ফার্মের মুরগির কাজ।
: ফার্মের মুরগি হয়ে...কী অদ্ভুত!
: শোনো, শুধু তোমাদের মতো দেশি মুরগিরাই যে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় হয়, তা না। আমাদের মতো খাঁচায় ভরে মাথার ওপর পাওয়ারফুল বাতি জ্বালিয়ে রাখলে তোমাদের অ্যাডভেঞ্চার কোথায় থাকত, বুঝতে!
: ইয়ে...মানে কীভাবে পালালে? কেনইবা পালালে? ওখানে তো নিশ্চিত জীবন। খাবার নিয়ে চিন্তা নাই। অসুখ হলে চিকিত্সার ব্যবস্থা আছে। কত দামি দামি খাবার...ইশ্!
: কিন্তু লাইফ নাই। সারা দিন খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকো, খাও আর ডিম দাও। এটা কোনো জীবন হলো? আমার ভালো লাগে না এসব। মুরগি হয়েছি বলে কি আমার ইচ্ছার দাম থাকবে না? খেয়ে খেয়ে মোটা হয়ে আরেকজনের পাতিলের রোস্ট কিংবা কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে ফ্রাই হওয়ার চেয়ে অনিশ্চিত জীবন অনেক ভালো।
: তা ঠিক।
: তাই পালিয়েছি। তিন দিন ঝিমানোর ভান করেছি। ব্যাটারা ভাবল, আমার রানীক্ষেত হয়েছে। আমাকে খাঁচা থেকে বের করে বাইরে নিয়ে এল, সুযোগ বুঝে দিলাম দৌড়! কোন দিকে দৌড়াচ্ছি জানি না, কিন্তু এটা জানি, দৌড়াতে হবে। থামলে চলবে না।
: উফ্! কী ডায়ালগ! রান, মুরগি রান!
: মানে? কী যা তা বলছ?
: আরে, ওই রান না! রান মানে দৌড়। আমি যেখানে থাকি, তার পাশের বাসার মেয়েটা প্রায়ই লাঠি নিয়ে আমাকে তাড়া করে। আর বলে, ‘রান, রান!’ তাই বললাম!
: ওহ্। তবে কোনো দিন এভাবে দৌড়াইনি। আসলেই পা ব্যথা হয়ে গেছে। খিদেও পেয়েছে খুব। কী খাওয়া যায়?
: তোমার সামনেই তো সুস্বাদু পোকা ঘুরঘুর করছে। খেয়ে ফেলো।
: পো...পোকা খাব?
: হ্যাঁ! খেয়েই দেখো কত মজা। আমি তো রোজ খাই! আচ্ছা, আমি জাম্বু, তোমার নাম?
: টুকি।
: খেয়ে নাও। তারপর তোমাকে এলাকাটা ঘুরে দেখাই। আরও অনেকের সঙ্গে পরিচিতও হতে পারবে। চলো।

২.
সহজেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল ওদের। টুকিকে পুরো এলাকাটা ঘুরিয়ে দেখাল জাম্বু। অপরূপ প্রকৃতি দেখে টুকি তো মুগ্ধ। এমন একটা জীবনের স্বপ্নই দেখে সে। যেখানে খাঁচায় বসে বসে ডিম দিতে হবে না। কারও প্লেটের খাবার হওয়ার জন্য তৈরি হবে না ও। এই প্রথম নিজেকে একজন আত্মনির্ভরশীল মুরগি মনে হলো তার। ভালো একজন বন্ধুও হয়েছে। খুশিতে গান ধরল সে।
এমন সময় বিশালদেহী এক মুরগি এল সেখানে। গলার লোমগুলো কে যেন নিষ্ঠুরভাবে চেঁছে ফেলেছে। ভয়ংকর দেখাচ্ছে মুরগিটাকে। জাম্বুকে ধমকে মুরগিটা জিজ্ঞেস করল, ‘অ্যাই, এ তো আমাদের এলাকার না। দেখে মনে হচ্ছে ফার্মের পণ্য। এখানে কী?’
: ও ফার্ম থেকে পালিয়েছে। এখন থেকে আমাদের এখানেই থাকবে।
: অসম্ভব! দেশি মুরগির সঙ্গে কোনো দিনই ফার্মের মুরগির মিল হতে পারে না। হাঁসের ডিম আর মুরগির ডিমের মতো তফাত আমাদের। তুই জানিস? বাজারে আমাদের কত চাহিদা? কাবাব বানালে আমরা হব চিকেন টিকা, আর ওরা হবে গ্রিল চিকেন। ওকে বের করে দে।
: বোঝার চেষ্টা করো। জন্মসূত্রে টুকিও কিন্তু আমাদের দেশেরই নাগরিক। তা ছাড়া দেশি আর ফার্ম বাইরে কেবল। ভেতরে সবারই সমান রাঙা।
: কী বললি তুই? অ্যাই কে আছিস, ধর ওদের!
: টুকি, রান! দৌড়াও!
জাম্বু আর টুকি ছুটতে শুরু করল। ওরা যখন দেখল, কেউ তাড়া করছে না, তখন বিশ্রাম নিতে বসল একটা গাছের নিচে। টুকি বলল, ‘উনি কে?’
: নেতৃস্থানীয় মুরগি। আন্তজেলা মুরগি সমিতির প্রধান। থাকে না কিছু নীতিনির্ধারক লেভেলের লোক? ফার্মের মুরগিদের সহ্যই করতে পারে না।
: ও। তো এখন আমরা কী করব?
: সেটাই ভাবছি।

খুব বেশি ভাবতে হলো না। হঠাৎ কী যেন পড়ল ওদের মাথার ওপর। একটু পর দুজনেই বুঝল ওরা জালে বন্দী। আড়াল থেকে কেউ জাল ফেলেছে ওদের ওপর।

৩.
জাম্বু আর টুকির জায়গা হলো স্থানীয় এক বাজারে। ওদের বিক্রি করে ভালো টাকাই পেয়েছে লোকটা। আরও অনেক মুরগির সঙ্গে পা বেঁধে মাটিতে ফেলে রাখা হয়েছে টুকি আর জাম্বুকে। ক্রেতারা শক্ত হাতে টিপেটুপে দেখছে ওদের। হতাশ হয়ে গেল টুকি। মাত্রই নতুন জীবনের স্বাদ পেতে শুরু করেছিল সে। এখন আবার সেই অপেক্ষা। কী বানাবে ওকে? রোস্ট না কোরমা? নাকি আলুর ঝোলে ভাসবে ওর টুকরাগুলো? এমন সময় কোমল একটা হাত স্পর্শ করল ওদের। একজন ক্রেতা ওদের গায়ে হাত বুলিয়ে বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কত দাম?’
: দেশি না ফারম? মুরগা না মুরগি? কোনডা?
দ্বিধায় পড়ে গেল ক্রেতা। স্ত্রী কী বলেছিল, তা কিছুতেই মনে করতে পারল না। কোনটা নিতে বলেছিল? দেশি না ফার্ম? মোরগ না মুরগি? শেষে বলেই ফেলল, ‘দেশি ফার্ম দুটোই দেন। একটা মোরগ আর একটা মুরগি।’

জাম্বু আর টুকি চলে এল নতুন হাতে। দুজনের বাঁধা পা ধরে রেখেছে হাতটা, মাথা নিচে ঝোলানো। এভাবে কখনো মাথা নিচু করে থাকেনি টুকি। যন্ত্রণায় লাল হয়ে গেছে তার মুখ। অন্যদিকে দৃষ্টি সরাতে জাম্বু বলল, ‘মুরগি হওয়ার সুবিধাটা দেখেছ? আমরা কিন্তু কারও পা ধরিনি। উল্টো মানুষই আমাদের পা ধরে আছে। হে হে হে।’
: আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। মাথাটা ছিঁড়ে যাবে মনে হয়।
: বলো কী! আচ্ছা, আমি ঠোঁট ঘষে পায়ের দড়িটা হালকা করছি। তারপর বললেই মাথা উঠিয়ে জোরে ঠোকর দেবে হাতটায়। একসঙ্গে। পারবে না?
: হু।
পায়ে দড়িটা হালকা হতেই নির্দেশ দিল জাম্বু। হলো না। হাত পর্যন্ত মাথা ওঠাতেই পারল না টুকি। কয়েকবার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হলো না। পুরোটা আবার বোঝাল জাম্বু। মাথা উঠিয়ে একসঙ্গে ঠোকর দিল দুজনে। কাজ হলো এবার। ঠোকরের আঘাতে চমকে ওদেরকে হাত থেকে মাটিতে ফেলে দিল লোকটা। দ্রুত ঠুকরে পায়ের বাঁধন আলগা করেই ঝেড়ে দৌড় দিল টুকি আর জাম্বু। লোকটা ঠোকর খাওয়া স্থানে হাত বোলাতে বোলাতে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে। দৌড়ে ধরার কথাও মনে হলো না তার। একসময় চোখের আড়ালে চলে গেল টুকি আর জাম্বু। তারা ছুটছে। কোথায়, তা কেউ জানে না।

৪.
ঠোকর খাওয়া হাতেই কলবেল চাপল লোকটা। দরজা খুলে স্ত্রী বলল, ‘একি! খালি হাতে এলে যে! মুরগি কোথায়?’
: হাত থেকে ছুটে গেছে!
: আশ্চর্য! মুরগি কীভাবে হাত থেকে ছুটে যায়! তুমি কী! একটা মুরগিও ধরে রাখতে পারো না?
: একটা নয়, দুটো। একটা দেশি, একটা ফার্ম।
: উফ্! কী যে করি তোমাকে নিয়ে!
: ইয়ে...তোমাকে তো ঠিকই ধরে রেখেছি এত দিন ধরে!
: কিসের মধ্যে কী! আচ্ছা, চলো, একসঙ্গে যাই। দেখি এবার কীভাবে ছোটে!
: চলো।