
‘ছুটির পর আজ কোথায় যাবে?’ ফস করে প্রশ্নটা করেই ফেলে দারা।
লিজু ভুরু কুঁচকে তাকায় ওর দিকে। বলে, ‘এটা জানা কি বিশেষ দরকার?’
একটা ব্যবসাসফল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে দুজন। পাশাপাশি বসে। একই পদ—জুনিয়র এক্সিকিউটিভ। প্রথম দিনই ওরা ‘তুমিতে’ নেমেছে বটে, সম্পর্কটা থেমে আছে ওখানেই। লিজু সুন্দরী, স্মার্ট। কাজেই দারার চোখে রং লাগাটা স্বাভাবিক। দারাও সুদর্শন, চটপটে। কিন্তু লিজু অতটা পাত্তা দেয় না।
দারা বলে, ‘না, বলছিলাম কি, আমার কাছে সিনেপ্লেক্সের দুটো টিকিট আছে। ক্যাপটেন আমেরিকা: সিভিল ওয়ার থ্রিডি ভার্সন দেখতাম।’
‘ওহ্, ঠায় বসে মুভি দেখা! সো মাচ বোরিং! স্যরি, স্যার!’
দারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করে। ভাবনাজুড়ে উড়ে বেড়ায় ‘লিজু’। ও কি কেবলই ফানুস হয়ে উড়ে বেড়াবে? কখনো ধরা দেবে না?
খানিক পর কফির অর্ডার দেয় দারা। লিজু বলে, ‘আমার জন্য এক কাপ আনতে বলো না।’
দারা তো এক পায়ে খাড়া। আনতে বলে। লাঞ্চের সময় দুজন একসঙ্গে ফুড কর্নারে গিয়ে খেয়ে আসে। বিলটা দারাই দেয়। ভাবে, এই তো সুবোধ মেয়ে। কিন্তু ছুটির পর ওকে কিছু না বলেই গটগট করে বেরিয়ে যায়। দারা পিছু পিছু বেরিয়ে দেখে, একহারা এক তরুণের সঙ্গে রিকশায় যাচ্ছে লিজু। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে ওর।
পরদিন কাজের ফাঁকে হেঁয়ালি করে দারা, ‘ছেলেটা বেশ স্মার্ট। হ্যান্ডসাম!’
লিজু বাঁকা হাসে, ‘কলজে পুড়ছে তো। তবে ও আমার কাজিন। দুই বছরের জুনিয়র।’
দারার কলজের ওপর কে যেন এক বোতল ফ্রিজের পানি ঢালে। আহ্, কী আরাম!
দুপুরের একটু আগে সেকি হইচই! কী হয়েছে, কী হয়েছে? ইঁদুরে ঠুকরেছে। কী ঠোকরাল? মদন চৌধুরীর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল।
আশ্চর্য ঘটনা বটে! সারা অফিস জানে কেঠো মদনকে। করপোরেট অফিসে এমন সিনিয়র এক্সিকিউটিভ লাখে একটা মেলে। যার ধাতানি খেলে জুনিয়রদের বাথরুম চাপা সারা দিনের জন্য বন্ধ, তার পায়েই কিনা ইঁদুরের ঠোকর! এমন খুশবু ছোটানো টিপটপ অফিসে ইঁদুরই বা এল কী করে?
লাঞ্চের সময় সবার মুখরোচক আলোচনা মদনের ইঁদুরকাহিনি নিয়ে। হা হা-হি হিতে ক্যানটিন সরগরম। ইঁদুর কাজ আর পেল না, মদনার পায়ে গেছে ঠোকর দিতে! ঝাড়বংশে নিপাত হবে এবার। নারী কর্মীদের মধ্যে যাদের ইঁদুরভীতি আছে, সেদিনের মতো দুপুরের খাওয়া শিকেয় উঠল তাদের।
এদিকে মদনের পোয়াবারো। দু-তিনজন বস দৌড়ে যান তার কাছে। একজন গম্ভীর মুখে বলেন, ‘কই দেখি, কোথায় কীভাবে কামড়াল হতচ্ছাড়া ইঁদুর?’
মদন ডান পা-টা উঁচিয়ে বলে, ‘কামড়াতে পারেনি, স্যার। শুঁকে গেছে।’
‘অ্যাঁ! কামড় দেয়নি তাহলে! যাক, বাঁচা গেছে!’
আরেক বস বলেন, ‘তোমাদের এই একটা বিচ্ছিরি স্বভাব, বুঝলে! অফিসে ঢুকেই জুতামোজা খুলে স্যান্ডেল পায়ে ঘোরো। আরে, বাবা, অফিস তো অফিসই। বাসা তো আর না।’
জুনিয়র যারা তেল নিয়ে ঘোরে, মদনের অনাবৃত পায়ে মালিশে তত্পর হলো। একজন বলে, ‘স্যার, ইঁদুর পা চিনেছে বটে। কার পা ধরলে এখানে জুতমতো থাকা যাবে, সেটা জানে!’
আরেকজন বলে, ‘একজন জেনুইন এক্সিকিউটিভের সৌরভ কেমন, সেটা শুঁকতে এসেছিল ইঁদুরটা!’
তেলটা পায়ে নয়, মদনের গাল বেয়ে নামে। বাসায় গিয়ে মোজা খুললে দৌড়ে পালায় সবাই, আর এ বলছে সৌরভ! মনে মনে তাকে একটা জঘন্য গাল দেয় সে।
ঘটনা এখানেই থেমে থাকে না। ‘মি. মদন বিটেন বাই র্যাট’ শীর্ষক একটি ফাইল তৈরি হয়ে যায়। পরদিন সে ফাইল নিয়ে সম্মেলনকক্ষে শীর্ষ কর্মকর্তাদের জরুরি বৈঠক বসে। কোত্থেকে ইঁদুর এসে মদনের পায়ে ঠোকর মেরে গেল, তা অনুসন্ধানে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন পেশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
কমিটির সদস্যদের হাতে হারিকেন, কপালে ঘাম, কিন্তু ইঁদুরের দেখা নেই। ইঁদুর নিধনে একদল ঠিকাদার ঘুরঘুর করতে থাকে অফিসে। চলে ফিসফাস, কানাকানি।
এর মধ্যে একদিন একটা মরা নেংটি ইঁদুর পাওয়া গেল। তা আবার লিজুর কম্পিউটারের পাশে। তার কাছে এটা যমতুল্য। পুরো অফিস কেঁপে উঠল লিজুর গলা ফাটানো চিত্কারে। দারা কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ঝিমোচ্ছিল। রাত জেগে বার্সেলোনার খেলা দেখার ফল। চেয়ার থেকে পড়ে দাঁত লেগে গেল তার।
দারাকে পুরো একটা দিন ক্লিনিকে থাকতে হলো। এই-সেই দিয়ে বিল উঠে গেল ১৩ হাজার টাকা। সেটা বড় কথা নয়। ও খুব আশা করছিল, লিজু অন্তত একটি বার এসে দেখা করে যাবে। ওর কারণেই তো এই দুর্গতি। কিন্তু আসা দূরে থাক, একটা ফোন পর্যন্ত করল না মেয়ে। এই দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছা করল দারার।
অফিসে ইঁদুর মারার জন্য মোটা অঙ্কের বাজেট বরাদ্দ হলো। দরপত্র ডাকা হলো। নানা ধরনের বিষের স্যাম্পল দিল কাজের ধান্দায় ঘোরা ঠিকাদারেরা।
স্যাম্পল তালিকাভুক্ত ও সংরক্ষণের দায়িত্ব পড়ল লিজুর ওপর। এসব নিয়ে তার হিমশিম অবস্থা।
সেদিন লাঞ্চের পর তাঁকে কফি খাওয়ানোর ছলে মনের কথাটা বলেই ফেলল দারা। এটাও বলল, দুনিয়ায় এমন কিছু নেই, যা সে লিজুর জন্য করতে পারে না।
লিজু তার পার্স থেকে ইঁদুরের বিষের একটা স্যাম্পল বের করে বলল, ‘তোমাকে খুব কঠিন কিছু করতে হবে না। শুধু এই বিষটা খেয়ে হজম করলেই চলবে।’
এ কথা শুনে দারার তো খাড়ার ওপর হার্ট অ্যাটাক হওয়ার জোগাড়। বলে কী এ মেয়ে! পটাপট ঢোক গেলে দারা।
লিজু কঠিন স্বরে বলে, ‘তোমরা—এই ছেলেরা, মেয়েদের কী ভাবো বলো তো! লোভনীয় স্যান্ডউইচ, বাটার টোস্ট? এখানে জয়েন করার পর থেকে তুমি আমাকে জ্বালিয়ে মারছ। আজ এর একটা হেস্তনেস্ত হবেই। হয় তুমি এ বিষ খাবে, নয় আমি। বি সিরিয়াস!’
এই বলে বিষের মোড়ক ছিঁড়ে কফিতে কালোমতো গুঁড়া ঢেলে গুলে নেয় লিজু। চুমুক দিতে যাবে, খপ করে ধরে ফেলে দারা।
‘না না, আমিই খাচ্ছি। চোখের সামনে তোমাকে মরতে দেব না!’
দারা বলে বটে, কিন্তু গলায় জোর পায় না। মনে হয়, শূন্যে ভাসছে শরীর। কফির কাপটা লিজুর হাত থেকে নেয় দারা। হাতটা কাঁপছে। ছলকে পড়ে খানিকটা কফি। লিজু চোখ পাকিয়ে বলে, ‘খবরদার, ফেলবে না!’
কফিতে বড় একটা চুমুক দেয় দারা। মাথাটা বোঁ করে ওঠে। এখনই যেন মূর্ছা যাবে। কম্পিত গলায় সে বলে, ‘আমাকে ধরো, লিজু! মাথাটা কেমন করছে!’
লিজু হেসে বলে, ‘তুমি আমার জন্য বিষ খেয়েছ, তোমাকে ধরব না, কী বলো! তবে কথা কি, জানো? ওটা আসলে বিষ না, ব্ল্যাক কফির গুঁড়া!’
এবার সত্যিই মূর্ছা যায় দারা।