বাবু-বিভ্রাট

অাঁকা: আসিফুর রহমান
অাঁকা: আসিফুর রহমান

২৫ বার রিং হওয়ার পর ফোন ধরল যূথী। আমার মনমেজাজ সাম্প্রতিক সময়ের আবহাওয়ার থেকেও উত্তপ্ত। ফোন ধরেই যূথী বলল, ‘হ্যালো, আমার বাবুটা, বলো...’
: তোমার বাবু মানে? আমি বাবু নাকি?
: হ্যাঁ, তুমি আমার বাবু!
: তুমি আমাকে আর বাবু বলবা না!
: না, বলব।
: কেন বলবা?
: কারণ, আমার বাবু বলতে ভালো লাগে। কী কিউট হয় বাবুরা! তুমি আমার কিউট বাবু।
: তাহলে, আমিও যা ভালো লাগে তাই বলে ডাকব তোমাকে?
‘হ্যাঁ, বলবা!’ যূথীর কণ্ঠে আহ্লাদী ভাব।
আমি সেটা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললাম, ‘তাহলে তুমি আমার প্যাঁচা। হ্যালো আমার প্যাঁচা, ভালো আছ?’
মুহূর্তেই যূথীর মধুমাখা কণ্ঠ কর্কশ শোনাল, ‘মানে কী? তুই আমাকে প্যাঁচা বললি কেন?’
: প্যাঁচা আমার ভালো লাগে তাই!
জানতাম, ওপাশ থেকে ফোন কেটে যাবে। হলোও তাই। ছোটবেলায় বাবু কেন উভলিঙ্গ শব্দ, তা ঠিকঠাক বুঝতাম না। কিন্তু এখন বুঝি; কারণ, গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ডকে এবং বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডকে বাবু বলে ডাকে, তাই বাবু একটি উভলিঙ্গ শব্দ। সে যা হোক, এই বাবু ডাক নিয়ে বেশ ঝামেলায় আছি। কেবল আমি নই, আমার গোটা পরিবার ঝামেলায় আছে।
সেদিন ছোট ভাই আমার মোবাইল ফোনটা চেয়ে নিল। কাকে যেন মেসেজ পাঠাবে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সে আমাকে বলে, ‘ছি ছি ছি, ভাইয়া, তুই এত নিচ, ছি!’ আমি আকাশ থেকে পড়লাম, ‘কী হলো?’ ছোট ভাই বলল, ‘তুই আমার গার্লফ্রেন্ডকে আই লাভ ইউ লিখে মেসেজ দিছিস!’ আমি এবার মহাকাশ থেকে পড়লাম, ‘মানে?’
: এই যে তুই ‘বাবু’ নামে সেভ করা কন্টাক্টে মেসেজ দিছিস, ‘বাবু, আই লাভ ইউ!’
লজ্জায়-অপমানে আমার মাথায় আগুন ধরে গেল! তারপরও রাগ সংবরণ করে বললাম, ‘আমার গার্লফ্রেন্ডকে আমি বাবু ডাকি।’
সেদিন ক্লাস থেকে বাসায় ফিরে এসে দেখি মা-বাবার মধ্যে সিরিয়াস ঝগড়া। মা নাকি দরজা বন্ধ করে রেখেছেন; কিছু একটা করে ফেলবেন। আমাদের কাজের বুয়া মা-বাবার ঝগড়ার কথোপকথন আমাকে বয়ান করল। ঝগড়ার সংলাপগুলো ছিল এ রকম—
: বুড়ো বয়সে তোমার ভীমরতি যায় না?
: মানে কী?
: মানে কী জানো না? হাড়হাভাতে বুড়ো! ছি, বুড়ো বয়সে এই দেখার বাকি ছিল আমার! এই মুখ আমি এখন কীভাবে বাইরে দেখাব! এর আগে মরে যেতাম, সেই ভালো ছিল! এসব রং-তামাশা আর দেখতে হতো না! ছি ছি ছি!
: আশ্চর্য! কী হয়েছে বলবে তো?
: আমার আর কিছু বলার বাকি আছে? আজকেই আমি বাপের বাড়ি চলে যাব...
সেই থেকে নাকি রুমের দরজা বন্ধ। বুয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন এমন হলো?’ উত্তরে সে বলল, আজ দুপুরে ল্যান্ডফোনে নাকি কোনো এক মেয়ে ফোন করেছিল। মা সেটা রিসিভ করেছিলেন। তারপর থেকেই এই অবস্থা। আমার মনে পড়ল, গত রাত থেকে রাগ করে আমার মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছি। কেউ ফোন করলে আমাকেই করবে। সেটা যূথী হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। কিন্তু এতে বাবার ওপর মায়ের রাগ হওয়ার কারণ কী?
বিকেলবেলা মা কিছুটা শান্ত হলেন। রুম থেকে বেরোনোর পর কড়া এক কাপ চা খেয়ে বললেন, ‘চোখের সামনে ঘুরঘুর করবি না। সামনে থেকে দূর হ। বাপ হয়েছে হাড় বজ্জাত, ছেলেপুলে আর কী হবে!’
আমি ভীরু পায়ে দুরুদুরু বক্ষে আরও খানিকটা সামনে এগিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলাম, ‘মা, কার ফোন এসেছিল যে তুমি এত খেপে গেলে?’
মা এমন একটা ঝাড়ি দিলেন যে চায়ের কাপটাও মনে হয় একটু কেঁপে উঠল, ‘কার আবার, তোর গুণধর জনকের! ফোন ধরে চুপ করে ছিলাম; ও মা, ছি ছি ছি! বলে কিনা, “বাবু, আই লাভ ইউ! প্লিজ ফোন কেটো না, বাবু!” ন্যাকা! কত্ত বড় বদমাইশ!’
আমার হাতের তালু আর পায়ের তালু ঘেমে একাকার। কপাল বেয়ে যে পরিমাণ ঘাম ছুটছে, সে পরিমাণ লবণ-পানি স্বয়ং মঙ্গলগ্রহেও নেই! তারপরও পরিস্থিতি বিবেচনা করে, বেচারা বাবাকে বাঁচাতে সত্যি কথাটা বলে ফেললাম, ‘মা, আসলে ওটা আমার ফোন ছিল! ফোন বন্ধ ছিল বলে ল্যান্ডফোনে নক করেছিল।’
মায়ের মুখটা এবার খানিকটা নমনীয় দেখাল। ছেলের মুখে এমন মেয়েবন্ধু-সম্পর্কিত তথ্য জেনেও কেন জানি নিশ্চিন্তের একটা আভা ফুটে উঠল। তারপরও আবার চোয়াল শক্ত করে জানতে চাইলেন, ‘তুই নিশ্চিত? দে দেখি ফোন তোর ওই মেয়েবন্ধুকে!’
আমি বাধ্য ছেলের মতো আড়ালে গিয়ে মেয়েবন্ধু ওরফে প্রেমিকা যূথীকে ফোন করলাম। আমার ধারণা সত্যি। মাকে এসে সেটা জানালাম। মা খানিকক্ষণ কড়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোর নাম আবার কবে থেকে বাবু হলো?’
আমি লজ্জায় পারলে মাটিতে মিশে যাই। উত্তরে আর কী-ইবা বলার আছে। ততক্ষণে বাবা পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। মা লজ্জামিশ্রিত কপট রাগের ভঙ্গি করে বললেন, ‘তুই জানিস না, তোর বাবাকেও আমি বাবু বলে ডাকি! বেয়াদব কোথাকার! দূর হ চোখের সামনে থেকে!’
বাবা ওরফে আমার মায়ের ‘বাবু’ তখন মিটিমিটি হাসছেন। আর কান পেতে শুনলাম, আমার ছোট ভাই ‘হাসতে হাসতে মরে যাচ্ছি’ ভাব করে তার গার্লফ্রেন্ডকে বলছে, ‘শোনো বাবু, হা হা হা...আজ বাসায় যা একটা কাণ্ড হয়েছে না! হা হা হা...’