বিরাজিল

.
.

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ ক্যাম্পাস ছেড়ে আসার প্রায় এক দশক হয়ে গেল। আমরা ব্রাজিল-সমর্থকেরা সে সময় বিশ্বকাপ ফুটবল এলেই ব্যাপক প্রস্তুতি নিতাম। প্রথম কাজই ছিল ব্রাজিল সমর্থকগোষ্ঠী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল শাখা কমিটি গঠন এবং চাঁদা তোলা। প্রায় ৫০০ ছাত্রের মধ্যে আমাদের সমর্থকই বেশি থাকত। তারপর সিদ্ধান্ত হতো ব্রাজিলের পতাকা, ব্যানার আর পতাকাখচিত হলুদ গেঞ্জি বানানোর। টিভি রুম ও হলের ফ্লোরে আলপনা ছাড়াও পোস্টার পেপার দিয়ে ব্রাজিলের পতাকা বানিয়ে সাজাতাম।
১৯৯৮ বিশ্বকাপ উদ্বোধনের দুই দিন আগে ব্যান্ডপার্টি ঠিক করতে গেলাম রোনালদোভক্ত লাভলু ভাইকে নিয়ে। সবাই তাঁকে মামা ডাকতাম। স্টেডিয়ামের মতো বিশাল টাক ছিল তাঁর। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার অনেক আগেই মাথা ন্যাড়া করে ফেলতেন। আমরাও অনেকে সেলুনে গিয়ে চুল বিসর্জন দিয়ে আসতাম।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের পাশের ব্রাহ্মপল্লি এলাকায় অনেক দর-কষাকষির পর এক হাজার টাকায় ব্যান্ডপার্টি ঠিক করলাম। মনে পড়ে, সেই বিকেলে প্রচণ্ড বৃষ্টির কবলে পড়েছিলাম। আমি তো পকেট থেকে অতিরিক্ত কোনো টাকাই খরচ করব না। কিন্তু লাভলু মামা বললেন, ‘আমরা বৃষ্টিতে ভিজুম আর হ্যারা ইনভার্সিটিতে মাঞ্জা মারব, হেইডা তো অইবার পারব না। চল ভাইগনা, আগে দুইজনে মিল্লা দুই প্লেট বিরানি মাইরা আহি গা।’
কী আর করা, ব্রাজিল-সমর্থকদের টাকায় (এর উৎস পুত্রের উচ্চশিক্ষার্থে পিতা কর্তৃক প্রেরিত নগদ অর্থ) ময়মনসিংহের প্রেসক্লাব ক্যানটিনে গিয়ে বিরিয়ানি খেতে হলো। ব্রাজিল খেলায় কোনো গোল দিয়ে বসলে আমাদের সমর্থকদের অনেকেই প্রজাপতির পাখার মতো হাত দুটোকে ডানা বানিয়ে টিভি সেটের সামনে গিয়ে সাম্বা নাচের বাংলাদেশি সংস্করণ প্রদর্শন করত। অনেক আর্জেন্টিনা-সমর্থকের পিত্তি জ্বলে যেত সেটা দেখে। ব্রাজিলের খেলার রাতে স্পেশাল খাবারের আয়োজন থাকত। বেশি মজা করতাম উদ্বোধনের দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সড়ক ছাড়াও কামাল-রঞ্জিত মার্কেট প্রদক্ষিণ শেষে ব্যান্ডপার্টিসহ র‌্যালির অবস্থান হতো সুলতানা রাজিয়া হলের গেটের সামনে। মনে হতো ক্যাম্পাসে বিশ্বকাপ ফুটবলের মূল আকর্ষণ এই মহিলা হলের গেট। একবার র‌্যালির নেতৃত্ব দিতে ২০ টাকা দিয়ে মাত্র ২ ঘণ্টার জন্য একটি নাদুসনুদুস দেশি ষাঁড় ভাড়া করেছিলাম আমরা। সবাই জানত যে এটিকেই রাতে জবাই দেওয়া হবে। মাংস ঠিকই খেয়েছিলাম, তবে ওই ষাঁড়ের নয়, বাজার থেকে কিনে। সুলতানা রাজিয়া হলের সামনে স্লোগান উঠত আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে। আবদুল মতিন ভাই তুখোড় ছাত্রনেতা। স্লোগানের ভালো জবাব দিতে পারতেন তিনি, তবে উচ্চারণে বেশ ত্রুটি ছিল। স্লোগানগুলো হতো এ রকম, ‘ওই জিতবে কে?’ মতিন ভাই ফাটিয়ে বলতেন, ‘বিরাজিল!’ একসময় দেখা গেল তিনি দুটো কাজই চালিয়ে যাচ্ছেন গগনবিদারী চিৎকার করে, ‘উই রুনাল্ডুর (রোনালদো) বিরাজিল, উই সবচেয়ে বেশি চ্যাম্পিয়ন বিরাজিল, উই পিলের (পেলে) বিরাজিল, উই তুমার (তোমার) বিরাজিল, উই আমার বিরাজিল...!’
আবিদ করিম
পান্থপথ, ঢাকা