কদিন বাদেই পুরো বিশ্ব কাঁপবে ফুটবল-জ্বরে। বাংলাদেশেও লাগছে সেটার আঁচ। মাঠে না থাকলেও গ্যালারিতে থাকছে বাংলাদেশ! এ ক্ষেত্রে খেলোয়াড়েরা হলেন আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের অসংখ্য কর্মী বাহিনী। তাঁদের হাতেই তৈরি হচ্ছে বিশ্বকাপের জন্য সমর্থকদের জার্সি। সেসব জার্সিতে লেখা থাকবে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। পড়ুন বিস্তারিত

দেশের নাম ব্রাজিল। শহরের নাম রিও ডি জেনিরো। স্টেডিয়ামের নাম এস্তাদিও দো মারাকানা। ঘটা করে নিশ্চয় বলতে হবে না, কদিন পরে সেখানে কী ঘটতে যাচ্ছে! হ্যাঁ, ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল আসর বসছে ওই স্টেডিয়ামে। এক লাখ ৯৯ হাজার ৮৫৪ জন দর্শকের সঙ্গে সারা বিশ্বের ফুটবল-ভক্তরাও সেখানেই মিশে যাবেন সেদিন। স্টেডিয়ামে জড়ো হওয়া দর্শকের পরনে থাকবে প্রিয় দলের জার্সি। দূরদেশের দর্শকদের অমন উল্লাসের সঙ্গে আমরাও মাতব নিশ্চয়ই!
কিন্তু একবার ভাবুন তো, এস্তাদিও দো মারাকানায় বসে থাকা দর্শকের পরনের জার্সিটা তৈরি করেছেন সাভারের হেমায়েতপুরের মর্জিনা খাতুন। পরম যত্ন আর মমতায় যে জার্সিটি তিনি তৈরি করেছেন, তা-ই পরে আছেন কোনো ব্রাজিলিয়ান অথবা আর্জেন্টিনার এক ভক্ত। যাঁর শরীরে শুধু জার্সি নয়, লেগে আছে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগটাও। এই একটি ভাবনাই আপনার শরীরের লোম খাড়া করে দিতে যথেষ্ট নয় কি? বাংলাদেশ ফুটবল দল কবে বিশ্বকাপ খেলবে, সেই তর্কে না গিয়ে এই আনন্দটুকু আমরা উপভোগ করতেই পারি। দল না হোক, বাংলাদেশের মানুষের হাতে তৈরি জার্সি ঠিকই আছে বিশ্বকাপের আসরে!

হেমায়েতপুর টু ব্রাজিল
রাজধানী ঢাকার পাশেই হেমায়েতপুর। সেখান থেকে সিঙ্গাইর রোড ধরে এগোলেই এজেআই গ্রুপ। বিশাল কারখানা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ প্রতিষ্ঠান। এর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুপালি পর্দার আলোচিত নায়ক এম এ জলিল অনন্ত। তাঁর বিশাল কারখানায় তৈরি পোশাকের অন্যতম ক্রেতা মার্কিন প্রতিষ্ঠান ইউএস পোলো অ্যাসোসিয়েশন। এ বছরের শুরুর দিকে ওই প্রতিষ্ঠান এজেআই গ্রুপকে পাঁচ লাখের বেশি পোশাকের অর্ডার দেয়। সবই বিশ্বকাপের জার্সি। এর মধ্যে মেয়েদের জার্সির অর্ডার দিয়েছে প্রায় দেড় লাখ পিস, ছেলেদের সাড়ে তিন লাখের বেশি। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা তো আছেই; মেক্সিকো, ইংল্যান্ড, ইতালি ও চীনের জার্সিও তৈরি করা হয়েছে এখানে। এরই মধ্যে সেই জার্সি চলে গেছে ইউএস পোলো অ্যাসোসিয়েশনের কাছে। সেখান থেকে যাচ্ছে সোজা ফুটবল-ভক্তদের হাতে। বলাবাহুল্য, এবারের বিশ্ব ফুটবল আসরের প্রাণকেন্দ্র ব্রাজিলেই গেছে বেশির ভাগ অংশ। তবে এজেআই গ্রুপের কারখানা ঘুরে দেখা গেল আরও কিছু জার্সির কাজ এখনো বাকি। কর্মীরা দ্রুত সেগুলোর কাজ করছেন। দু-এক দিনের মধ্যেই এই জার্সিগুলো জাহাজে চাপবে। পাড়ি দেবে তেরো নদী সাত সমুদ্র।
বিশ্বকাপ ঘিরে জার্সি তৈরির ধুম নিয়ে কথা বলেন এজেআই গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জলিল অনন্ত, ‘এজেআই গ্রুপ থেকে এর আগে জার্সি তৈরি করা হয়নি। তবে ইউএস পোলো অ্যাসোসিয়েশন কোম্পানির কাজ করা হয়েছে। এ বছরের শুরুতে ওই কোম্পানি আমাদের জার্সি তৈরির অর্ডার দেয়। অর্ডার পাওয়ার পরই আমাদের প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করি। কারণ, আমরা মনে করি, বিশ্বকাপের জার্সির সঙ্গে মানুষের আবেগ যেমন জড়িয়ে থাকে, তেমনি আমাদের দেশের মান-সম্মানও জড়িয়ে আছে। তাই অত্যন্ত যত্ন নিয়ে তৈরি করতে হবে প্রতিটি পোশাক এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পৌঁছে দিতে হবে ফুটবলপ্রেমীদের কাছে। সেই লক্ষ্যে আমাদের কর্মীরা দক্ষতার সঙ্গে তৈরি করেছেন বিশ্বকাপের জার্সি।’

মেড ইন বাংলাদেশ
এজেআই গ্রুপের মান পরির্দশক বেবিনা খাতুন। তাঁর হাতেই নিশ্চিত হয় পোশাকের মান। বিশ্বকাপের জার্সির বেলায়ও তা-ই ঘটছে। কেমন লাগছে বিশ্বকাপের অংশ হতে পেরে? প্রশ্ন শুনে হাসেন হেমায়েতপুরের এই পোশাককর্মী, ‘অনেক ভালো। মনে হচ্ছে আমাদের দেশও বিশ্বকাপে খেলছে!’ ব্রাজিলের সমর্থক বেবিনা এবারের সব খেলাই দেখবেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে। তাঁর মতো একই পদে কাজ করেন সাবিনা ইয়াসমিন। মাঝেমধ্যে খেলা দেখেন বটে। তবে এবার আর মিস করবেন না কোনো খেলাই। কারণটা তো অনুমেয়, ‘এবারের বিশ্বকাপে আমাদের হাতে তৈরি জার্সি যাচ্ছে। এটা কি কম আনন্দের! এই খুশিতেই এবার খেলা দেখব।’
এজেআই গ্রুপের আরেক কর্মী আনসারুল ইসলাম। তাঁর প্রিয় দল আর্জেন্টিনা। পছন্দের খেলোয়াড় মেসি। নিজের হাতে বানিয়েছেন প্রিয় খেলোয়াড়ের নম্বরসংবলিত জার্সি। কেমন লেগেছে জার্সি তৈরির সময়? প্রশ্ন শুনে একগাল হেসে উত্তর দিলেন, ‘চাকরিজীবনে এত আনন্দ নিয়ে কখনোই কাজ করি নাই। এ জন্য আর্জেন্টিনার কোনো খেলা এবার মিস করব না।’
জার্সিতে সম্মান, জার্সিতে আয়
সারা বছরই খেলার সামগ্রী তৈরি হয় দেশের শতাধিক নিট পোশাক কারখানায়। ফলে বিশেষ কোনো কার্যাদেশ নয়, বরং অনেকটা ‘সাপ্লাই চেনের’ মধ্যেই বিশ্বকাপের পণ্যসামগ্রী তৈরি করে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো।
বিশ্বকাপ উপলক্ষে রিবক, নাইকি, অ্যাডিডাস, পুমা, কেরিফোর, সিঅ্যান্ডএ, এইচঅ্যান্ডএমসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ড প্রস্তুত থাকে নানা রকম খেলার সামগ্রী নিয়ে। এ সময় ফুটবলপ্রেমীদের চাহিদা থাকে জার্সি, ট্রাকস্যুট, মোজা, হাফপ্যান্ট, হ্যাটের ওপর; যেসব মূলত বাংলাদেশের
কারখানাগুলোতেই তৈরি হয়েছে।
বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে কত টাকার বা কত পিস পোশাক রপ্তানি হয়েছে সে হিসাব করা কঠিন। কারণ, প্রত্যেক ব্যবসায়ী পোশাক মালিকদের দুই সমিতি বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ কোনো কর্তৃপক্ষের কাছেই আলাদা করে হিসাব দেন না। তা ছাড়া ক্রেতাদের কিছু শর্তের কারণে মুখ খোলেন না ব্যবসায়ীরাও। তবে ধারণা করা হচ্ছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত নিট পোশাক খাত থেকে ৮৮৩ কোটি ডলার রপ্তানি আয় হয়েছে। আর এই রপ্তানির অন্তত ৩ শতাংশ এসেছে ফুটবল বিশ্বকাপকেন্দ্রিক পণ্যসামগ্রী থেকে।

একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ২০১০ বিশ্বকাপের চেয়ে এবার ব্যবসা কিছুটা কম হয়েছে। গত বছরের রানা প্লাজা ধস ও পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক ক্রেতাই কার্যাদেশ দেয়নি। তবে এসব সমস্যা ভবিষ্যতে না থাকলে ব্যবসা আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ, দেশের পোশাক কারখানাগুলো কাজের পরিবেশ উন্নয়ন ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে।
অবশ্য নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানালেন, প্রায় ১০০ কোটি ডলারের জার্সিসহ অন্যান্য সামগ্রী বিশ্বকাপের জন্য গেছে। আর সংখ্যার হিসাবে ৫০ কোটি পিস। তবে এই তথ্যগুলো ধারণানির্ভর বলেও জানালেন তিনি। বিভিন্ন বাধানিষেধের কারণে সঠিক তথ্য পাওয়া সত্যিই কঠিন।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও বাফুফের পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী বললেন, ‘বিশ্বকাপে না খেললেও বাংলাদেশ এতে এক অর্থে অংশ নিচ্ছে ঠিকই। গ্যালারির দর্শকেরা যে জার্সি গায়ে দিয়ে খেলা দেখবেন বা যে পতাকা নাড়িয়ে প্রিয় দলকে সমর্থন দেবেন, তার অনেক কিছুই বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় তৈরি। ইউরোপের ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি খেলার সামগ্রী তৈরি করায়। এসব পণ্য শুধু ব্রাজিল নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিক্রি হয়। পণ্যের গায়ে লেখা থাকে—মেড ইন বাংলাদেশ। এটি অবশ্যই গর্বের।’
এম এস ডায়িং এবারের ফুটবল বিশ্বকাপে প্রায় ২০ লাখ পিস সমর্থকদের জার্সি রপ্তানি করেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করলেন নারায়ণগঞ্জের এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হাতেম, ‘আমরা সারা বছরই খেলার পোশাক তৈরি করি। আগের একাধিক বিশ্বকাপেও আমরা সমর্থকদের জার্সি তৈরি করেছি। এটা যেমন সম্মানের তেমনি আর্থিক দিক থেকেও ইতিবাচক ঘটনা। ’