
বিকিকিনি ডটকমে বিজ্ঞাপন দেখে একটা ঘোড়া কিনে ফেলল সালেকিন। ঘোড়ার চশমা আছে। আসলে সাজ দেখেই কিনেছে। হোক না ঘোড়া, এ যুগে স্মার্ট না হলে চলে?
কৌতূহল নিয়ে বন্ধুরা অনেকেই দেখতে এল। এত কিছু থাকতে ঘোড়া কেন?
সালেকিন বুক ফুলিয়ে বলল, ‘বাসে ভাড়া বৃদ্ধি, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় মিটার নিয়ে হুজ্জতি, রিকশাওয়ালার সঙ্গে খেঁচাখেঁচি—কাঁহাতক আর সওয়া যায়? এর চেয়ে তো ঘোড়াই ভালো। যানজটেও থোড়াই কেয়ার।’
বন্ধুরা অনেকে মেনে নিল, ঠিকই তো, সালেকিন মিছে বলেনি। বাহন হিসেবে ঘোড়া অতুলনীয়। রাজা-বাদশা আর বীর যোদ্ধারা তো ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়েই ইতিহাস গড়েছেন।
কিন্তু ঘোড়ার চশমা খুলতেই চিচিং ফাঁক। তার এক চোখ কানা। গোসল করানোর সময় নকল রোম সব ঝরে গেল। বেরিয়ে এল বুড়ো এক বেতো ঘোড়ার আসল চেহারা।
সালেকিন বিকিকিনি ডটকমে ফোন করে বেশ হম্বিতম্বি করার চেষ্টা করল। তাদের এক কথা, ‘আরে ভাই, দেখেই তো কিনেছেন! চশমা ফাঁক করে চোখ পরখ করতে আপনাকে মানা করেছে কেউ?’
ঘোড়া নিয়ে বিপদে পড়ে গেল সালেকিন। এই চতুষ্পদ জন্তু তিন পায়ে ভর করে এক পা ভেঙে শুধু ঝিমায়। পিঠে চড়লে নড়ে না। খাওয়ায়ও যেন অরুচি। সালেকিনের ঘুম হারাম। টাকা গেছে যাক, এখন এই আপদ নিয়ে কী করা যায়!
যাকে সাধে, সেই মুখ ফিরায়। এই অথর্ব জিনিস দিয়ে কী হবে? এর খরচ জোগাবে কে? রাখার জায়গা কোথায়? রোজ রোজ এত্ত লাদার গতি কী?
কায়দা করে বুড়ো এক ভিখিরিকে ডেকে আনে সালেকিন। তার কাঁধে গছানোর চেষ্টা করে আপদ। সে আঁতকে উঠে বলে, ‘ইতা কিতা কন! ঘোড়ায় উঠলে মাইনষে আমারে ভিখ দিতনি? প্যাডে লাত্থি মারনের তামশা? দূর-অ, দূর-অ!’
গভীর রাতে সালেকিন ঘোড়াটাকে তেরাস্তার মোড়ে ছেড়ে দিয়ে আসে। যা, যেদিক খুশি চলে যা।
পরদিন ভোরে জগিং করতে বেরিয়ে সালেকিনের চক্ষু গোল গোল লাড্ডু। ঘোড়াটা দিব্যি গেটের সামনে খাড়া। জুতমতো জায়গায় চলে এসেছে।
প্রাতর্ভ্রমণে বের হওয়া বয়সী এক নারী এসে ঘোড়াটার আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সালেকিন এগিয়ে যেতেই তিনি বেশ আগ্রহ নিয়ে বলেন, ‘বাবা, ঘোড়া এল কোত্থেকে?’
সালেকিন মিথ্যা বলতে পারলেই বেঁচে যেত, কিন্তু ঘোড়াটা তার এক চক্ষু দিয়ে এমন কাতরভাবে তাকাল, মুখ দিয়ে সত্যি কথাই বেরোল। বলল, ‘ঘোড়াটা আমারই, আন্টি।’
‘এটা তো দেখছি বুড়ো ঘোড়া। তোমার কী কাজে লাগবে?’
‘জি, তা ঠিকই বলেছেন।’
‘বেচবে নাকি?’
অ্যাঁ, বলে কী! এটারও তা হলে ক্রেতা আছে!
‘সত্যি কিনবেন?’
সালেকিনের প্রশ্নে রেগে গেলেন আন্টি, ‘কী বলো তুমি! তোমার সঙ্গে রঙ্গ করার বয়স আছে আমার? আর এই সাতসকালে কেউ মিথ্যা বলে!’
সালেকিন সতর্ক হয়ে যায়। ঘোড়া দিয়ে এই বয়সী নারীই বা কী করবেন? ওর মতো ঝোঁকের বশে কিনে পরে ঠিকই ঝামেলা পাকাবেন। সালেকিন বলে, ‘ঘোড়ার কিন্তু একটা চোখ কানা।’
‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি।’
‘এটা দুনিয়ার কুঁড়ে। একটুও নড়ে না।’
‘এ জন্যই তো নিতে চাচ্ছি। আমার নাতিরা চড়ে খুব মজা পাবে। তেজি হলে তো নিতেই চাইতাম না। শোনো, আমার দুই নাতির একটার বয়স সাত, আরেকটার চার। এখনো জ্যান্ত ঘোড়া দেখার সৌভাগ্য হয়নি ওদের। পঙ্খীরাজ ঘোড়ার গল্প বললে নাতিরা আমার কেমন যে করে, তা যদি একবার দেখতে!’
আহ্, দাদি বটে! মুগ্ধ হয়ে যায় সালেকিন। দামদরে বাতচিত করে না। পানির দরে ল্যাঠা চোকায়। মহিলা বেশ দাপুটে। শিগগিরই দুজন লোক নিয়ে আসেন তিনি। দাম মিটিয়ে ঘোড়া নিয়ে যান। যাওয়ার সময় রহস্য করে বলেন, ‘আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিচ্ছি এই ঘোড়া। সেটা তোমাকে বলতে চাই না।’
সালেকিন মহিলার ঠিকানা রেখে দেয়। মনের ভেতর খচমচ। কী এমন সেই কাজ? কৌতূহল দমাতে পারে না।
কিছুদিন পর পায়ে পায়ে সেই মহিলার ঠিকানায় গিয়ে হাজির সালেকিন। বাড়ির সামনে এক চিলতে লন। তারই এক পাশে রয়েছে সেই ঘোড়া। এক বৃদ্ধ নিবিষ্ট মনে ঘোড়ার পরিচর্যা করছেন। সালেকিনকে দেখে ছুটে আসেন আন্টি। সালেকিন বোকার মতো বলে, ‘চলে এলাম, আন্টি।’
‘তা তো আসবেই। হাজার হলেও নিজের পোষা প্রাণী। মায়া তো থাকবেই।’
‘আপনার নাতিরা কই? ঘোড়া পেয়ে নিশ্চয়ই ওরা খুব খুশি?’
‘না রে, বাবা। যা ভেবেছিলাম তা হয়নি। ঘোড়ার ধারেকাছেও যায় না ওরা। বলে পাখা কই?’
‘তাহলে তো আপনার লস!’
‘আরে না না, আসল কথা তোমাকে তো বলিনি। ঘোড়া তো কিনেছি আসলে ওই বুড়োটাকে দাওয়াই দিতে।’
‘মানে?’
‘ঘোড়ার পাশে যে বুড়োটাকে দেখেছ, সে তোমার আঙ্কেল। ও এমনিতেই খুব বদমেজাজি। রিটায়ার করার পর মেজাজ আরও তিরিক্ষি হয়ে যায়। বুঝলে, চটি খুঁজতে গিয়ে বাড়ি মাথায় তোলে। কিছুতেই বাগে আনতে পারছিলাম না। এখন ঠিকই বুঝতে পেরেছে, একটা বুড়ো ঘোড়ার ভার সামলানো কতটা ঝক্কির!’