আজ কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মদিন। কবির স্মরণে ফ্রান্সের প্যারিস থেকে লিখেছেন পার্থ প্রতিম মজুমদার

রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে
সাধিতে মনের সাদ ঘটে যদি পরমাদ
মধুহীন করো না গো তব মনঃ কোকনদে।
প্রবাসে, দৈবের বশে, জীব-তারা যদি খসে
এ দেহ-আকাশ হতে,— নাহি খেদ তাহে।
কবিতাটি কার লেখা, পাঠকদের নিশ্চয় তা আর বলে দিতে হবে না। যিনি বাংলা সাহিত্যের আকাশে একটা বিশাল ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন—গর্ব করার জন্য বাঙালিদের একটা অবলম্বন দিয়েছিলেন। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম হয়েছিল আমাদেরই এই বাংলাদেশের যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে ১৮২৪ সালের এই দিনে।
মাত্র সাত বছর বয়সে গ্রামছাড়া হলেও নিজের শিকড়ের প্রতি আন্তরিক আকর্ষণ সারা জীবন তাঁর মধ্যে টিকে ছিল। তাঁর সাহিত্য ও তাঁর জীবনের নানা ঘটনা বিশ্লেষণ করলে নিজের উৎসের প্রতি তাঁর এই দরদ কত আন্তরিক ও শক্ত ছিল, নির্ভুলভাবে তা বোঝা যায়। সাগরদাঁড়ি থেকে চলে যাওয়ার ৩০ বছর পরে এবং ছয় হাজার মাইল দূরে বসেও তিনি তাঁর শৈশবের গ্রামের প্রতি নাড়ির টান অনুভব করেছেন। বাল্য ও কৈশোরকালে তাঁর মনে, বিশেষ করে যা গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল, তা হলো গ্রামবাংলার নিসর্গ।
আমার ফ্রান্সে আসার বয়স তিন দশক ছাড়িয়েছে। এ দেশে আসার বহু আগ থেকেই ভার্সাই শহরের প্রতি ছিল প্রচণ্ড আকর্ষণ। সেটা ভার্সাইয়ের রাজপ্রাসাদ বা ফরাসি দেশের একসময়কার ১০০ বছরের রাজধানী দেখার জন্য নয়, আমার টান ছিল আমাদের এক শ্রেষ্ঠ কবি একসময় কী কষ্টে এই শহরে কাটিয়েছেন, কেমন বাসায় ছিলেন—সেগুলো দেখা এবং তাঁর স্পর্শ পাওয়া জিনিসগুলো স্পর্শ করার।
কবি ১৮৬২ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে ইংল্যান্ড এসেছিলেন ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য। ‘গ্রেজ ইন’-এ যোগও দিয়েছিলেন, পরিবার তখন রেখে এসেছিলেন কলকাতায়। এক বছরও পূর্ণ হয়নি, ১৮৬৩ সালের ২ মে স্ত্রী হেনরিয়েটা সন্তানসহ ইংল্যান্ড চলে আসেন। কারণ, যাদের ওপর তিনি বিষয়-সম্পত্তির দায়িত্ব দিয়ে ইংল্যান্ডের পড়ার খরচ পাঠানোর ও পারিবারিক মাসিক টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করে এসেছিলেন, তারা সবাই কবি ও তাঁর পরিবারকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। কোনোভাবে ইংল্যান্ড আসার ভাড়ার টাকা জোগাড় করে সন্তানসহ হেনরিয়েটা ইউরোপ এসে পৌঁছান। অর্থাভাবে মধুসূদন চরম বিপদে পড়লেন। বন্ধুবান্ধবকে বহু চিঠি লিখেও কোনো ফল পাওয়া গেল না। ইংল্যান্ডে সপরিবারে বসবাসের চেয়ে ফ্রান্সের ভার্সাইয়ে বসবাসে অর্থ খরচ কম পড়বে বিবেচনায় ১৮৬৩ সালের মধ্যভাগে তিনি সপরিবারে ভার্সাই চলে আসেন।
১৬৭১ সালে রাজা চতুর্দশ লুই সপ্তদশ শতাব্দীতে ভার্সাই প্রাসাদ তৈরি করেন। ১০০ বছরের চেয়ে বেশি সময় ধরে এই শহর ছিল ফ্রান্সের রাজধানী। ১৮৬০-এর দশকে এই শহরের জনসংখ্যা ছিল মাত্র হাজার চল্লিশ, ২০০৯ সালের হিসাবে ৮৬ হাজার ৪৭৭ জন। প্যারিস শহর থেকে ভার্সাই শহরের দূরত্ব ২১ কিলোমিটার। প্যারিস শহর থেকে ভার্সাই আসার অনেক ব্যবস্থা আছে। প্যারিসের দক্ষিণে অবস্থিত রেলস্টেশন কাম মেট্রোস্টেশন ‘মম পারনাস’ থেকে ট্রেনে ভার্সাইয়ের শঁতিয়ে নামের স্টেশন, যার থেকে মাত্র পাঁচ থেকে ছয় মিনিটের হাঁটাপথে পড়বে ১২ নম্বর রু দ্য লা এতা জেনেরো (যার আগের নাম ছিল রু দে শঁতিয়ে)।

এই বাড়ির দোতলার ছোট্ট দুটি ঘরে ১৮৬৩-১৮৬৫ সাল পর্যন্ত আমাদের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি। ভার্সাই শহরের এই বাসায় কেটেছে তাঁর জীবনের চরম দুঃখের দিনগুলো। অচেনা পরিবেশে কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারেননি অথবা হয়তো সম্মানে লাগবে ভেবে চেষ্টাও করেননি। সামান্য টাকাপয়সা তখনো হাতে যা ছিল, তা দিয়ে যাতে সবচেয়ে বেশি সময় টিকে থাকা যায়, তার জন্য তিনি অথবা হেনরিয়েটা চেষ্টার কোনো কসুর করেননি। জীবিকা নির্বাহের জন্য স্ত্রীর অলংকার, গৃহসজ্জার উপকরণ ও পুস্তকাদি বন্ধক বা বিক্রি করে চলতে হয়েছিল। এ সময় আশপাশের মানুষের কাছে প্রচুর ঋণও জমে গিয়েছিল। বহু মাসের বাসা ভাড়া বাকি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকানে বহু টাকা বাকি—পাগলপ্রায় অবস্থা! ঋণের দায়ে একবার জেলে পর্যন্ত যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল—সে সময় তাঁর গুণগ্রাহী এক ফরাসিনী তাঁকে জেলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচান। চাতক পাখির মতো প্রতিদিন ডাকের অপেক্ষা করতেন—কলকাতা থেকে কখন তাঁর প্রাপ্য টাকা এসে পৌঁছাবে। অথবা দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর কখন তাঁকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে অর্থ পাঠাবেন, তার অপেক্ষায় বুকভরা আশা নিয়ে দিন গুনতেন। এ সময় তিনি প্রায় প্রতিদিনই তাঁর পাওনাদারদের কাছে এবং বিপদের দিনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছে চিঠি লিখতেন। তাঁর মতো এত বড় অসাধারণ কবি ও বড়লোক বাড়ির ছেলে হয়ে (যিনি গুনে কোনো দিন টাকা কাউকে দেননি) এ সময়ে যে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন, তা ভাবলে আজও অবাক লাগে।
এত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও তাঁর প্রতিভা থেমে থাকেনি। ভার্সাইতে অনাহার ও অর্ধাহারের মধ্যেও নতুন ভাষা শিক্ষার অথবা সাহিত্যচর্চার উৎসাহ কখনোই তিনি হারাননি। ভার্সাই থাকাকালীন তাঁর জীবনের একটি মুখ্য রচনা চতুর্দশপদী কবিতাবলী রচনা করেন। মাইকেল ভার্সাইতে বসবাসকালে ইটালিয়ান বিখ্যাত কবি দান্তের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে একটি সনেট রচনা করে ইতালীয় ও ফরাসি ভাষায় নিজকৃত অনুবাদসহ ইতালির রাজা ভিক্টর ইমানুয়েলের কাছে পাঠিয়ে দেন। আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির ঐক্যের দিক থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে কবির এই প্রচেষ্টা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। দয়ার সাগর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁকে অর্থ পাঠিয়ে রক্ষা করেন এবং কবি ‘গ্রেজ ইনে’ যোগ দিতে ১৮৬৫ সালে ইংল্যান্ড চলে যান, কিন্তু অর্থ সাশ্রয়ের জন্য পরিবারকে ১৮৬৯ পর্যন্ত ভার্সাইতে রেখে যান। ১৮৬৪ সালের ৩ আগস্ট হেনরিয়েটা একটি মৃত কন্যাসন্তানের জন্ম দেন এই বাড়িতে, তখন তাঁর বয়স ২৭ বছর। আর্থিক সচ্ছলতা কিছুটা ফেরার পরই অন্য এলাকার তুলনায় গরিব পাড়া থেকে এক লাফে ভার্সাইয়ের সবচেয়ে বনেদি পাড়া রাজপ্রাসাদের গা ঘেঁষে প্রাসাদের সবচেয়ে বিখ্যাত ফোয়ারা ‘Bassin de Neptune’-এর মুখোমুখি ফ্ল্যাটে হেনরিয়েটাকে নিয়ে তুলেছিলেন। এ বাসার ঠিকানা ৬ নম্বর রু মোপাসাঁ। ১৮৬৯ পর্যন্ত হেনরিয়েটা এ বাসায় বাস করেছেন কলকাতায় ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। এ বাসাতেই জন্ম হয়েছিল কবির ছোট ছেলে এলবার্ট জর্জ নোপোলিয়ানের।
লেখক: মূকাভিনেতা