
মাতৃভাষা সমাসবদ্ধ পদ। ব্যাকরণের নির্দেশ অনুযায়ী যষ্ঠী তৎপুরুষ। অভিধানে অর্থ লেখা আছে স্বদেশের ভাষা। কিন্তু অভিধানের অর্থে সকলের চিত্ত সন্তুষ্ট হয় না। হওয়ার কথাও নয়। ভাষার স্বভাবই হলো অস্পষ্ট থাকা, অন্তরাল সৃষ্টি করা, হরবোলার কৌতুকে মেতে ওঠা। ভাষা খেলা করে জিবের ডগায়, ঘোষিত হয় গলার মধ্য দিয়ে, প্রাণ লাভ করে ফুসফুস থেকে। এও বাইরের সত্য। আসলে ওর জন্ম বুকের মধ্যে, উৎস মানুষের মন। মন কি কোনো নিয়মের বশ হতে চায়? একই ভাষা একজনের মুখে মধু, অন্য জনের মুখে বিষ। সকাল-বেলায় কলহের হাতিয়ার, দুপুরে কর্মের বাহন, অপরাহ্নে শ্রান্তির, সন্ধ্যায় স্বপ্নের। আমার মাতৃভাষা বাংলা, মাত্র এইটুকু বললেই কি সবটা উত্তর সম্পূর্ণ হয়?
বিষয়ী লোকের বিবেচনাও কম বৈচিত্র্যপূর্ণ হয় না। আমার এক পরিচিত বুজর্গ আছেন। আপনাদেরও পরিচিত। তিনি নিজের মাতৃভাষাকে সবিশেষ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি সাফ জবাব দিয়েছেন যে, পণ্ডিতের বাংলা তাঁর মাতৃভাষা নয়। একেবারে নির্জলা মায়ের বুলিই তাঁর মাতৃভাষা। মামার বাড়ির সকল আব্দার আমারও খুব প্রিয়, কিন্তু তাই বলে মাতুলালয়ের ভাষাই আমার মাতৃভাষা। এমন কথা স্বীকার করতে আমি নারাজ। আমি কি অপরাধী?
এক অধ্যাপক আছেন, তিনি তাঁর অঞ্চলের বুলির অকৃত্রিম ভক্ত। তিনি বই ছাপিয়ে প্রচার করেছেন যে, তাঁর দেশে কৃষকে বিরিষ বলে, অতএব তিনিও বিশুদ্ধ বাংলায় কৃষকে বিরিষ রূপে লিখবেন ও বলবেন না কেন? যিনি বলবেন তিনি বলতে পারেন আমি বাধা দেবার কে? তবে আমার মাতৃভাষা বৃষভশক্তির হবে এমন সম্ভাবনা অনিবার্য মনে করি না।
...আমার এক সহকর্মী আছেন। বাংলা ভাষা প্রচলনের সকল প্রয়াস পদে পদে উপেক্ষিত ও লাঞ্ছিত হতে দেখে তাঁর মনের প্রশান্তি নষ্ট হয়ে গেছে। গুলি চলেছে ১৯৫২তে, তারপর উনিশ বছর পার হয়ে গেছে। কই, বাংলা ভাষা তো কোথাও প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। যেখানে যতটুকু পেরেছে তাও লোষ্ট্র নিক্ষেপ ছাড়া সাধিত হয়নি, গোলাগুলি, কাঁদুনে গ্যাস ও কারাবাস ছাড়া বাংলা ভাষাকে কেউ সূচ্যগ্র ভূমিও ছেড়ে দেয়নি। ধুতুরার বিষ কি মানুষের মনে অকারণে প্রবেশ করেছে? আমার সহকর্মী আজ তাই কোনো সুকোমল নির্বিষ বাংলা ভাষাকে নিজের মাতৃভাষা বলে জাহির করতে রাজি নন। তিনি আমাকেও বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, বাংলা ভাষার মঙ্গলের জন্যই আমাদের প্রত্যেকের মাতৃভাষা হওয়া উচিত ইস্টক। মাতৃভাষার এই পরিণতির কথা আমরা কি পূর্বে কখনও ভাবতে পেরেছি?
হয়তো তাই। যার যা প্রাণের ভাষা, সেটাই তার মাতৃভাষা। কারও মাতৃভাষা খিস্তি, কারও মিছরি। আমি নিজেও এমন অনেককে জানি, যাঁদের মাতৃভাষা ঘরে আঞ্চলিক বুলি, অফিসে ইংরেজি, প্রণয়-নিবেদনে বিশুদ্ধ বাংলা, রোষ প্রকাশে অশুদ্ধ উর্দু।
আমার মাতৃভাষা কী? বাংলা ভাষা। সমগ্র বাংলা ভাষা। বিচিত্ররূপিনী বাংলা ভাষা। অভিধানে আছে ষোড়শ রমণী মাতৃসম্বোধনীযোগ্য। শ্বশ্রূ থেকে তনয়া, গর্ভধারিণী সহচরী। আমার মাতৃভাষা তিব্বতের গুহাচারী, মনসার দর্পচূর্ণকারী, আরাকনের রাজসভার মণিময় অলঙ্কার, বরেন্দ্রভূমির বাউলের উদাস আহ্বান। মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ইসলাম আমার মাতৃভাষা। আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষা।
মুনীর চৌধুরী রচনাবলী থেকে