
সামাজিক চাপ ও জীবনধারায় পরিবর্তনের কারণে মানুষ কম ঘুমাতে বাধ্য হচ্ছে। মধ্যবয়সী মানুষেরা অন্যদের তুলনায় সবচেয়ে কম ঘুমান, যা ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ঘুম সাত-আট ঘণ্টার চেয়ে কম। নতুন এক গবেষণায় একদল বিজ্ঞানী এই পরিস্থিতিকে ‘বৈশ্বিক নিদ্রাসংকট’ হিসেবে দেখছেন।
গবেষকদের মতে, স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে আধা ঘণ্টা কম ঘুমালে মানুষের বোধশক্তি ও স্বাস্থ্যের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ে। অনিদ্রায় ভুগলে অজান্তেই মানুষের বোধশক্তি কমে। একটানা দীর্ঘদিন ঘুম কম হলে স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
গবেষণাটি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। তাঁদের গবেষণা প্রতিবেদনটি গত শুক্রবার সায়েন্স অ্যাডভান্সেস সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়, জৈবিক প্রক্রিয়ায় মানুষের ঘুমাতে যাওয়ার কথা সন্ধ্যার পরপরই। কিন্তু জীবনযাপনের ধরনে পরিবর্তনের কারণে তারা দেরিতে ঘুমায় এবং ঘুম সংক্ষেপ করে।
স্মার্টফোনের একটি বিশেষ অ্যাপের (এনট্রেইন) মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য থেকে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষকেরা বিশ্বের ১০০টি দেশের প্রায় ছয় হাজার মানুষের ঘুমের ধরন বিশ্লেষণ করেন। এ ক্ষেত্রে বয়স, লিঙ্গ এবং প্রাকৃতিক আলোয় মানুষ কত সময় থাকে, তা গবেষণার বিবেচনায় নেওয়া হয়। এতে দেখা যায়, পুরুষের তুলনায় নারীরা গড়ে ৩০ মিনিট বেশি ঘুমান। গড় হিসাবে তাঁরা পুরুষের চেয়ে আগে ঘুমাতে যান এবং জাগেন দেরিতে। আর যেসব মানুষ প্রতিদিন প্রাকৃতিক আলো বা সূর্যালোকের সংস্পর্শে বেশি সময় কাটান, তাঁরা সাধারণত আগে আগে ঘুমিয়ে পড়েন।
বাংলাদেশের মানুষের ঘুমের ধরন বা অভ্যাস নিয়ে জাতীয় পর্যায়ের কোনো তথ্য-উপাত্ত মেলেনি। তবে এশিয়া অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে মিল রেখে এ দেশের একদল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক গত বছর বিশ্ব নিদ্রা দিবসে আয়োজিত এক সেমিনারে জানিয়েছিলেন, এ দেশের মধ্যবয়সী পুরুষদের ৬০ শতাংশ এবং নারীদের ৪০ শতাংশ ঘুমের সমস্যায় ভুগছেন। বাড়তি ওজন বা শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা ছাড়া অন্য কারণেও মানুষ নিদ্রাহীনতার শিকার হতে পারে। ঘুমের সময়টা নির্দিষ্ট হওয়া দরকার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল শনিবার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের নাক-কান-গলা এবং হেড নেক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মনিলাল আইচ প্রথম আলোকে বলেন, শারীরিক বা ব্যক্তিগত সমস্যার পাশাপাশি স্লিপ হাইজিন বা পরিবেশগত সমস্যার কারণেও মানুষের ঘুম কম হয়। আজকাল টেলিভিশন দেখা, কম্পিউটারের কাজ, মুঠোফোনে আলাপ ইত্যাদি শেষ করে অনেকে রাতে দেরি করে বিছানায় যায়। ব্যাপারটা নিয়মিত বা অভ্যাসে পরিণত হলে ঘুমের স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট হয়।
ঘুমের আদর্শ পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বয়সটা প্রাধান্য পায়। যুক্তরাষ্ট্রের ওই বিজ্ঞানীরা ১৫ বছরের বেশি বয়সী প্রায় ছয় হাজার মানুষের ঘুমানো, জেগে ওঠা এবং আলোকোজ্জ্বল পরিবেশে সময় কাটানোর অভ্যাসের তথ্য নেন। পাশাপাশি তাদের বয়স, লিঙ্গ, দেশ এবং স্থানীয় সময়ের তথ্যও সংগ্রহ করা হয়। তবে নাম-ঠিকানা নেওয়া হয়নি। ওই গবেষণায় দেখা যায়, সিঙ্গাপুর ও জাপানের মানুষের গড় ঘুমের সময় সর্বনিম্ন—৭ ঘণ্টা ২৪ মিনিট। আর এটা সবচেয়ে বেশি নেদারল্যান্ডসে—৮ ঘণ্টা ১২ মিনিট।
এমনিতে মানুষের ঘুম একটি অভ্যন্তরীণ ঘড়ি বা ‘জৈব ঘড়ির’ মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। ২০ হাজার স্নায়ুকোষের সমন্বয়ে একদানা চালের আকৃতির ওই প্রাকৃতিক ঘড়ির অবস্থান মানুষের চোখজোড়ার পেছনে। সেখানে যে পরিমাণ আলো (মূলত প্রাকৃতিক আলো) পড়ে, তার ভিত্তিতেই ঘুমের পরিমাণ নির্ধারিত হয়।
গবেষক দলে যুক্ত ছিলেন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেনিয়েল ফরগার। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘রাতে বেশিক্ষণ জেগে থাকার ইচ্ছা এবং সকালে ঘুম থেকে ওঠার মধ্যে একটা লড়াই হয়ে থাকে। সমাজই আমাদের দেরিতে ঘুমানোর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু জৈব ঘড়ি আমাদের সকাল সকাল জাগিয়ে দিতে চায়। এই দ্বন্দ্বের মাঝখানে পড়ে ঘুম কমে যাচ্ছে।’