মালিহার সহজ প্রযুক্তি-জীবন

মালিহা মালেক কাদির সহজ ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তাঁর যত কাজ প্রযুক্তি নিয়েই। কোন কোন প্রযুক্তিপণ্য তাঁর নিত্যসঙ্গী? সেসবই জানাচ্ছেন মাহফুজ রহমান
মালিহা কাদির। ছবি: খালেদ সরকার
মালিহা কাদির। ছবি: খালেদ সরকার

কারওয়ান বাজার থেকে গুলশানে ২–এ যেতে হবে। সেখানে অপেক্ষা করছেন সহজ ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা মালিহা মালেক কাদির। আমাদের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন তাঁর প্রযুক্তিজীবন নিয়ে। প্রযুক্তিজীবন বলতে কোন গ্যাজেট তিনি ব্যবহার করেন, কোন অ্যাপগুলো তাঁর নিত্যসঙ্গী—এসবই। অ্যাপ নিয়েই যখন কথা হবে, তখন তাঁরই বানানো ‘সহজ রাইডস’ বেছে নিলাম গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। তখন সকাল সাড়ে ১০টা। নভেম্বরের ৭, বুধবার ছিল সেদিন।

সহজ রাইডসের চালক লুৎফর রহমান যখন গন্তব্যে নামিয়ে দিলেন তখন তাঁকে জানালাম, ‘সহজ রাইডসের প্রতিষ্ঠাতার কাছে যাচ্ছি কথা বলতে। আপনার কিছু বলার আছে তাঁকে?’ ৩৫–৩৬ বয়সী লুৎফর মাথা থেকে হেলমেট নামাতে নামাতে হেসে বললেন, ‘আমি একটা ফার্মেসি চালাই, মাঝে সময়–সুযোগ পেলে রাইড দিই। এটা একটা বাড়তি আয়। তাঁকে একটা ধন্যবাদই দিয়েন।’

মালিহা কাদিরকে সেটা জানাতেই বোঝা গেল, মনে মনে তিনি খুব খুশি। মুখে সেটা প্রকাশও করলেন, ‘ঠিক এই ব্যাপারটাই আমার চালিকাশক্তি। দেশের বাইরে (যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত) নানা জায়গায় পড়াশোনা এবং কাজ করার পর দেশে এসেছি এ কারণেই। মানুষের জীবন আরও সহজ করার জন্যই চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রতিদিন।’

 ফোন যখন প্রাণভোমরা

আর আপনার প্রতিদিনের কাজগুলো সহজ করে দিচ্ছে কোন কোন গ্যাজেট? বা কোন কোন অ্যাপ?—আমাদের প্রশ্ন। মালিহার ঠান্ডা লেগেছিল, নাক হয়ে ছিল অনেকটা তাঁর গায়ের চাদরটার মতোই—লাল! টেবিলের ওপর রাখা হালকা গোলাপি রঙের কভারে মোড়ানো ফোনটার দিকে চোখ ইশারা করে মালিহার জবাব, ‘ফোনটাই তো সারাক্ষণ ব্যবহার করি। ওটাই সবকিছু সহজ করে দিচ্ছে। আমি এখন ব্যবহার করছি আইফোন টেন। ফোনেই এখন সবকিছু আছে, ফলে সেভাবে আর কোনো গ্যাজেটের দরকারও হয় না। একসময় ফিটবিট ব্যবহার করতাম, আইফোনে সেই সুবিধা পাই বলে সেটাও আর ব্যবহার করছি না। স্মার্টওয়াচে আপাতত আগ্রহ নেই। তবে ল্যাপটপ তো আছেই, সেটাও অ্যাপলের—ম্যাকবুক।’

 কলেজে ফোন ছিল না মালিহার

ম্যাকবুকের আগে মালিহার দীর্ঘদিনের সঙ্গী ছিল এইচপির একটি ল্যাপটপ, তারও আগে ডেলের। ‘এইচপির ল্যাপটপটা অনেক দিন ব্যবহার করেছিলাম,’ বলছিলেন মালিহা, ‘ব্যাংকিং সেক্টরে যখন ছিলাম (যুক্তরাষ্ট্রের মরগ্যান স্ট্যানলি এবং সিঙ্গাপুরে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক) তখন এক্সেলের কাজ ছিল বেশি, যেটা ওই ল্যাপটপগুলোতে ভালোভাবে করা যেত। তবে ব্যাংকিং সেক্টর ছেড়ে আসার পর, অর্থাৎ প্রায় ৯–১০ বছর হলো ম্যাকবুক বেছে নিয়েছি।’

ম্যাকবুকের বিশেষ সুবিধাগুলোই এর প্রধান কারণ। ঠিক যেমনটা আইফোনের বেলায়ও খাটে। মালিহার কাছে অ্যান্ড্রয়েড ফোনের তুলনায় আইফোন অনেক বেশি স্মার্ট। মজার ব্যাপার হলো, কলেজজীবনে তাঁর কোনো ফোনই ছিল না! সেটা ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সালের কথা। তখন তিনি পড়াশোনা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ কলেজে, অর্থনীতি ও কম্পিউটারবিজ্ঞান বিষয়ে। ২০০০ সালে নিউইয়র্কে মরগ্যান স্ট্যানলি বিনিয়োগ ব্যাংকে যোগ দেওয়ার পর অফিস থেকে পেলেন একটা ব্ল্যাকবেরি ফোন। মালিহার মতে, ‘তখন ব্যাংকিং এবং ফিন্যান্স সেক্টরে ব্ল্যাকবেরি ফোনটা খুব জনপ্রিয় ছিল। এরপর ২০০৯ সালে নকিয়ায় যোগ দিয়ে এশিয়ায় এলাম।’

এখানে না বললেও বুঝে নিতে হয়, তখন তাঁর হাতে কোন ফোন এল। মালিহা বলছিলেন, ‘নকিয়া তখন খুবই জনপ্রিয়। তারপর নকিয়া ছাড়ার পর শুরু হলো আইফোনের পালা।’

প্রযুক্তি ঘিরেই মালিহার প্রতিদিনের কাজ
প্রযুক্তি ঘিরেই মালিহার প্রতিদিনের কাজ

 দরকারি যত অ্যাপ

আইফোন মালিহার প্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ, ‘ইউজার ফ্রেন্ডলি এবং অনেক অ্যাপ আছে এখানে।’ অনেক অ্যাপের ভিড়ে কোন অ্যাপগুলো আপনার প্রিয়, বেশি ব্যবহার করেন? মালিহার তালিকাটা এ রকম, ‘সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাপগুলোই বেশি ব্যবহার করি। ফেসবুক সবার ওপরে, তারপর ইনস্টাগ্রাম। লিংকডইন আমি নিয়মিত খুলি। খুবই কাজের অ্যাপ। দেশের বাইরে বেশি জনপ্রিয় ছিল, এখন দেশেও খুব চলছে। এটা দেখতে ভালোই লাগে। এ ছাড়া ড্রপবক্স ব্যবহার করি কাজের জন্য। চ্যাটের জন্য তো হোয়াটসঅ্যাপ খুবই দরকারি। এই অ্যাপটি এখন অনেক নতুন নতুন সুবিধা যুক্ত করেছে। উইচ্যাটও নিয়মিত ব্যবহার করি ব্যবসার প্রয়োজনে চীনের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে।’

ভিডিও কনফারেন্সও খুব জরুরি বিষয়। সেটার বেলায় মালিহার এখনকার প্রিয় জুম ভিডিও কমিউনিকেশনস। বছরখানেক আগেও অবশ্য আস্থা রাখতেন স্কাইপে। আর দেশি অ্যাপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আস্থা বিকাশে। এত এত অ্যাপের কথা হলো, আপনার বানানো অ্যাপ নিজে ব্যবহার করেন? মালিহা বললেন, ‘হ্যাঁ, গাড়ির জন্য প্রায়ই সহজ রাইডস ব্যবহার করতে হয়। সব মিলিয়ে কাজের অ্যাপই বেশি ব্যবহার করি আমি।’

 অবসর আর ভবিষ্যতের প্রযুক্তি

কাজের অ্যাপের বাইরে মালিহার অবসরের সঙ্গী অ্যাপগুলোর মধ্যে অন্যতম দুটি হলো—আইটিউনস আর গানা। তবে গানের কথামতো তিনি বলতেই পারেন, ‘ব্যস্ততা আমাকে দেয় না অবসর’। দুই সন্তান—১৩ বছরের আনুশকা আর ৭ বছরের সোফিয়াকে দেওয়ার মতো সময়ও খুব কম। ফলে ৭ বছরের আনুশকা যখন ৩ বছর বয়স থেকে আইপ্যাড চালায় তখন ‘হ্যাঁ’–ও বলতে পারেন না, ‘না’ বলতেও ঠেকে। মালিহার অসহায় আত্মসমর্পণ, ‘ওদের দোষ দিয়েই–বা কী লাভ, ওদের যাওয়ার জায়গা তো নেই। তা ছাড়া পড়াশোনা করতেও এখন ইন্টারনেট, ল্যাপটপ অপরিহার্য। ছোট মেয়েটা তো পড়া শিখছে র‌্যাজ–কিডস নামের অ্যাপটা দিয়ে। চমৎকার একটা অ্যাপ। বড় মেয়েটাও তা–ই করে। আগেই বলেছি, ঝামেলাও আছে অনেক। সেসব মাথায় রেখেই আমরা ওদের রাত আটটার পর থেকে গ্যাজেট ব্যবহার করতে দিই না। ভবিষ্যতের এই বিষয়গুলো নিয়ে এখনই ভাবা দরকার।’

ভবিষ্যতের অ্যাপ বা গ্যাজেট নিয়ে কী ভাবছেন মালিহা? খানিকক্ষণের ভাবনা–বিরতি নিয়ে বললেন, ‘ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক হিসাবের অ্যাপ হতে পারে একটা। আমার আয়–ব্যয়ের সব হিসাব–নিকাশ সেখানে থাকবে। কাগুজে টাকা বহন করা বেশ কঠিন। ফলে এই অ্যাপ তৈরি করতে পারলে ভালোই হবে।’

সহজ ডটকমই কি সেটা করবে? মালিহা লম্বা একটা হাসি হেসে বললেন, ‘বলতে বলতেই তো আইডিয়া চলে এল! দেখা যাক, হলেও হতে পারে। তবে একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি, শুনুন।’

মোবাইল ফোনের ভয়েস রেকর্ডার অ্যাপটা চালু করে মালিহার অভিজ্ঞতা শুনতে কান পাতলাম। তিনি ফিরে গেলেন ২০০৬–০৮ সালের দিকে, ‘তখন আমি হার্ভার্ডে এমবিএ করছি। সেটার মাঝখানে আমার স্বামী বাংলাদেশে এলেন একটা কাজ নিয়ে। তখন আমার বড় মেয়েটা একদম ছোট। আমিও এলাম। ব্র্যাকনেটে আমরা একটা ক্লাসিফায়েড সাইট বানালাম। এখন যেটা বিক্রয় ডটকম। তো সেই সাইটে একটা পুরোনো ফ্রিজ বিক্রি করে এক বাবা এলেন তাঁর মেয়েকে নিয়ে। তিনি এসেছিলেন শুধু একটা ধন্যবাদ দিতে। ধন্যবাদ কেন? কারণ, তিনি ওই ফ্রিজটা বিক্রি করে মেয়েটার কলেজের খরচ মিটিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে তিনি এত আবেগতাড়িত ছিলেন যে, সেটা আমাকে দারুণ উৎসাহ জুগিয়েছিল। প্রযুক্তি যে মানুষের জীবন কতটা সহজ করে দিয়েছে, এটা একটা উদাহরণ।’

বুঝতে কষ্ট হয় না, এ কারণেই মালিহা কাদির তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন—সহজ!

এক নজরে
সহজ ডটকম প্রতিষ্ঠার আগে মালিহা কাদির যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। ঢাকার সাউথ ব্রিজ ও স্কলাস্টিকায় পড়াশোনা করে মালিহা যান যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন মালিহা। এর আগে স্মিড্‌থ কলেজ থেকে অর্থনীতি ও কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক হন। মরগ্যান স্ট্যানলিতে বিনিয়োগ ব্যাংকিং নিয়ে কাজ শুরু করেন। বাংলাদেশের ব্র্যাকনেটেও কাজ করেন কিছুদিন। ২০০৮ সালে যোগ দেন মুঠোফোন প্রতিষ্ঠান নকিয়া সিঙ্গাপুরে। সে সময় ব্যবসায় উন্নয়ন ব্যবস্থাপক হিসেবে ভারত, চীন, নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশে নকিয়ার ডিজিটাল কনটেন্ট সেবা নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা হয় তাঁর। নকিয়ার পর সিঙ্গাপুরে ডিজিটাল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভিস্তাপ্রিন্টে কাজ করেন। গত বছর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ঘোষিত ১০০ জন ইয়াং গ্লোবাল লিডারের (ওয়াইজিএল) তালিকায় স্থান পেয়েছে মালিহার নাম। ১৭ নভেম্বর দ্য ডেইলি স্টার আইসিটি অ্যাওয়ার্ডস ২০১৮–তে স্টার্ট–আপ অব দ্য ইয়ার পুরস্কার পেয়েছে মালিহা কাদিরের সহজ ডটকম। মালিহার বাবা মো. আবদুল মালেক এবং মা নার্গিস মালেক। ২০০০ সালে মালিহা বিয়ে করেন খালিদ কাদিরকে। তাঁদের দুই মেয়ে আনুশকা ও সোফিয়া।