মায়ের কাছে পত্র

আজ আমার মাকে আমার একটা চিঠিই দিই না কেন। ফেসবুক চ্যাট আর এসএমএসের দুনিয়ায় আমার মায়ের কাছে সত্তর দশকের রীতিতে একটা চিঠিই লেখার চেষ্টা করি বরং...
আম্মা,
তোমার মা অর্থাৎ আমার নানি যেহেতু পীর বংশের মহিলা ছিলেন সে কারণেই হয়তো আমাদের মা-এর বদলে ‘আম্মা’ ডাকটা শিখিয়েছ। জন্মের পর পর তুমি আমাকে ঢাকায় ভূতের গলির এক বাসায় নিয়ে এসেছিলে। সেখানে তুমি সারা দিন একটি যৌথ পরিবারের সংসার সামলাতে ব্যস্ত থাকতে। মনে পড়ে তিন বেডরুমের সেই বাসায় অনেক মানুষ থাকত। আমার তিন চাচাতো ভাই, দুই মামা, আব্বা আর তোমার একজন সহযোগী পুরুষ গৃহকর্মী। কী করে তুমি পুরো পরিবারটাকে সামলাতে আমি জানি না। কোনো দিন সকালের নাশতায় ভুল হতে দেখিনি। টিফিনও দেখতাম, সব ঠিকঠাক, নিখুঁত। প্রতিটি মানুষের সবকিছু তুমি গুছিয়ে দিতে কী দারুণ মমতায়। কী অসম্ভব প্রেমে যে সংসারের কাজ করে যেতে তার সিকিভাগ যদি আমাদের নাগরিক জীবনের মানুষেরা তার কর্মক্ষেত্রে করতে পারত তাহলে বোধ হয় এই শহরটার আমরা অন্য চেহারা দেখতাম। শৈশবে তুমি আমাকে খুব বেশি সময় দিতে পারতে না জানি। সংসার সামলানোর বিশাল দায়িত্বে যখন তোমার হিমশিম দশা, সে সময় আমাদের বাসার নিচতলায় আমাদের বিধবা বাড়িওয়ালি আমাকে নিয়ে তাঁর অবসরটা কাটাতেন। সে জন্য উনাকে আমি ডাকতাম নিচতলার আম্মা। আম্মা, তুমি আমাকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখতে কি না জানা হয়নি কিন্তু তোমার পুরো যৌথ পরিবারটার জন্য অগাধ ভালোবাসাটা আমি এখন বুঝতে পারি। ঢাকার একটি মধ্যবিত্ত মুসলিম যৌথ পরিবারের চেহারা আমাদের ছিল। বাসার সবার মধ্যে তুমি তৈরি করেছিলে এক মানবিক সম্পর্ক, সেই সঙ্গে এক উদার সৃজনশীল বোধ।
আম্মা, অনেক কথাই বলা হয়নি, বলা হয়ে ওঠে না, তাই আজ আমার ৪০ বছরের জীবনে এসে আমি বুঝি, জীবনদর্শনে মূলত তুমিই ছিলে সব সময়। যখন আমাদের নতুন মেহমান এল অর্থাৎ আমার বোন মৌ এল তার কয়েক বছর পর আমাদের বিশাল যৌথ পরিবার ছোট হয়ে গেল। আমরা চলে এলাম গ্রিন রোডের বাসায়। সেখান থেকে বলা যায় তোমার সন্তানদের নিয়ে তুমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলে। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হতেও সময় লাগল না। অচিরেই আমার শারীরিক অসুস্থতা ধরা পড়ল। অসুস্থ আমাকে নিয়ে তুমি হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেছ। আম্মা, এখন অবাক হয়ে ভাবি সেই দিনগুলোতে কি অসীম ধৈর্যের পরীক্ষাই না তুমি দিয়েছিলে!

এক পা থেকে দুপা, তারপর হাত, আমার শরীরের সব ‘জয়েন্ট’ যখন রিউমাটইড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হতে শুরু করল; এমন সময় পৃথিবীর সবাই আমাকে নিয়ে আশা হারিয়ে ফেললেও তুমি হারাওনি। তাই হয়তো হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমাকে শত মনীষীদের কথা বইটা পড়িয়েছিলে। আম্মা, অনেকে বলে আমার নাকি জীবনীশক্তি অনেক বেশি। কিন্তু আজ বলতেই হয় এই শক্তি ধার করা, তোমার কাছ থেকে আমি নিয়েছি। আমি যখন কলেজজীবনে রাজনীতি করতে চেয়েছি, নতুন সমাজের কথা বলতে শুরু করেছিলাম, তখন অনেক বাধা দিয়েছিলে। আমাকে নিয়ে তোমার ভয় ছিল। তোমার নিজের বিশ্বাসের চেয়েও বড় হয়ে গিয়েছিল সমাজের মানুষের চোখ।
তুমি ভয় পেয়েছিলে আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে। পাছে আমি গোল্লায় যাই, কিন্তু আমি জানতাম যে জীবনীশক্তি তুমি আমাকে দিয়েছ আর যে আদর্শে তুমি বড় করেছ তার থেকে খুব বেশি বিচ্যুত আমি হব না।
কলেজে পড়ার সময় আমার বন্ধুদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিলাম। কারণ তোমার এই উদার মানসিকতাটাই বলা যায় পেয়ে বসেছিলাম। রাত-দিন আড্ডা আর আড্ডার খোরাক চা-নাশতার প্রতি কোনো দিন কার্পণ্য ছিল না। লোকে বলে যার বন্ধু নেই সে অসহায়। আমার জীবনে একটা শক্তি আমার বন্ধুরা। সেই বন্ধুদের মধ্যে আবার ছেলেমেয়ে কোনো পার্থক্য ছিল না। সবার জন্য এই উদার আধুনিক সৃজনশীল পরিবেশ তুমি তৈরি করেছিলে। আম্মা তোমার একাডেমিক পড়াশোনা বেশি না। কিন্তু তুমি প্রমাণ করেছ উদার মানসিকতার জন্য উচ্চশিক্ষিত হওয়া জরুরি নয়, জরুরি একটা উদার মনের। যে মন হিংসা, ক্রোধ আর লোভ থেকে মুক্ত।
আমার ছেলেমানুষি কবিতাটা তোমার জন্য—
মা,
কখনো বলা হয় নাই, সময় পাই কই।
কখনো জানা হয় নাই, সময় পাই কই।
কখনো দেওয়া হয় নাই,
সময় পাই কই।
আফসোসও হয়তো করা হবে না,
সময়ের অভাবে।
আজ শুধু ভাবি
নয় মাস কম সময় না।
যা পেয়েছি তা আর কেউ কি
দিতে পারে?
মা নিয়ে লিখেছেন—