
বান্দরবানের মিলনছড়ি রিসোর্ট। ঘড়ির বেঁটে পেট মোটা কাঁটাটা তখন বারোটার ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। একদল বন্ধু তখনো রিসোর্টের ক্যানটিনের লাগোয়া বারান্দায় বসে আড্ডায় মশগুল। কারও চোখে ঘুম নেই। কফির পেয়ালায় চুমুক, সঙ্গে গিটার আর গান। সামনে উঁচু উঁচু পাহাড়, অন্ধকারে হঠাৎ দেখলে কেমন গা ছমছম করে! এমন সময় জানা গেল, এক বন্ধু আড্ডায় ‘ফাঁকি’ দিয়ে ঘরে কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডা জমে, আর বেড়াতে এসে আড্ডায় ফাঁকি দিয়ে ঘুম? তা তো হবে না। ঠিক হলো, সেই বন্ধুকে ভয় দেখানো হবে। ভূতের ভয়! রাতের অন্ধকারে পা টিপে টিপে চলল একদল তরুণ!
তাসনিম আক্তারের বন্ধুর দলটার জন্য এমন রুদ্ধশ্বাস আনন্দের উপলক্ষ নতুন নয়। ছুটি পেলেই তাঁরা দল বেঁধে ছুটে যান প্রকৃতির কাছাকাছি। বান্দরবান, কক্সবাজার, রাঙামাটি, শ্রীমঙ্গল...টই টই করে ঘুরে বেড়ানোতে তাঁদের জুড়ি নেই। ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট ও পরীক্ষার চাপকে চাপা দিয়ে কটা দিন ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়ানোর এই সুযোগ তাসনিম কিছুতেই ‘মিস’ করতে চান না। তিনি জানান, সুযোগ পেলে পরিবারের সঙ্গে যে বেড়াতে যাওয়া হয় না, তা নয়। বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার মজাটা একেবারেই অন্য রকম। তা তো বটেই। বাসে দল বেঁধে যাওয়া থেকে শুরু করে খাওয়ার সময় এটা-ওটা নিয়ে কাড়াকাড়ি—জমজমাট থাকে সারাক্ষণ।
বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার মজাটা জানেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ইফ্ফাত আরাও। কলেজে পড়ার সময় শিক্ষাসফরে সুন্দরবন যান। সফরের সঙ্গে ‘শিক্ষা’ ব্যাপারটা থাকায় সেখানে শিক্ষকদের চোখরাঙানিও ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে সেসব নেই। বন্ধুরা মিলে প্রায়ই বাক্সপেটরা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। ‘প্রথমবার খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। বন্ধুরা সবাই যাচ্ছে, আমাকে আম্মু যেতে দেবেন কি না। ভয়ে ভয়ে আম্মুকে বলেই ফেললাম। আম্মু কোথায় যাচ্ছি, কে কে যাচ্ছি—এসব জানতে চাইলেন। বন্ধুদের সঙ্গে তিনি কথা বললেন। তারপর যখন রাজি হলেন, খুশিতে কী করব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না!’ বলার সময়ও তাঁর চোখে-মুখে সেই খুশির আভাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে এসে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকবার বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে তাঁর। ‘আম্মু তো তাঁর মেয়েকে চেনেন। মেয়ের বন্ধুবান্ধবকেও চেনেন। তাই একটু বকাঝকা করলেও, শেষমেশ নিষেধ করেন না। বেড়িয়ে আসার পর আম্মুকে ছবি দেখাই, আম্মুও খুশি হন।’ বলছিলেন ইফ্ফাত।
শুধু যে মেয়েদের জন্যই মা-বাবার কাছ থেকে অনুমতি পাওয়াটা কঠিন, তা নয়। ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমিনুর রহমান বলেন, ‘পত্রিকায় নানা দুর্ঘটনার কথা পড়ে এমনিতেই আব্বু-আম্মু ভয়ে থাকেন। বেড়াতে যেতে দিতে তো বাধা নেই। কিন্তু তাঁদের দুশ্চিন্তাও আসলে অমূলক নয়।’
কথা হলো স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রওনক ইমতিয়াজের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সামনের শীতে আমরা দল বেঁধে রাঙামাটি যাব। এখন থেকেই প্রস্তুতি চলছে।’
আরেক বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া আফনান ইউসুফের এখনো সেই সুযোগ হয়নি। আফনানের বাড়ি নোয়াখালী। ঢাকায় একাই থাকেন। মেয়ে দূরে থাকে বলে মা এমনিতেই খুব দুশ্চিন্তা করেন। মেয়েকে বন্ধুদের সঙ্গে যেতে দিতে সাহস পান না। মন খারাপ হলেও আফনান মায়ের দুশ্চিন্তাটা বোঝেন। তিনি বলেন, ‘আম্মু বলেছেন, পরেরবার যেতে দেবেন। এখন সেই অপেক্ষায় আছি।’
ওদিকে অভিভাবকেরা কী বলেন? কথা হলো ধানমন্ডির মাকসুদা রহমানের সঙ্গে। কপালে ভাঁজ পড়লেও, মেয়ের আনন্দের কথা ভেবে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যেতে বাধা দেন না বলে জানান তিনি। ‘যাতায়াতব্যবস্থা ঠিক আছে কি না, অভিভাবকদের মধ্যে কেউ যাচ্ছেন কি না, এসব জেনে নিশ্চিন্ত হলে যেতে দিই। বেড়াতে গেলেও ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ রাখি। তা ছাড়া ওর বন্ধুবান্ধবকে তো চিনি। মানা করি না।’