
গতকাল রাতেই বাবার সঙ্গে মায়ের ঝগড়া হলো, এটি হয়তো শেষবারের মতোই ছিল, আমি কিছুই বুঝিনি। বয়স হবে হয়তো মাত্র এক বছর। এই হুট করে লেগে যাওয়া ঝগড়া ছোট্ট সংসারের আশার প্রদীপের আলো দপ করে বন্ধ করতে যথেষ্টই ছিল।
বাবা একজন পুলিশ অফিসার। অন্যায় দমন করাই তাঁর প্রধান কাজ, দমনকার্য করতে গিয়ে নিজ সংসার দমন করে ফেলেছেন। বাবা ছেড়ে দিলেন রক্তের সম্পর্ক, ভালোবাসার সম্পর্ক।
বাবা চলে গেলেন। আবার বিয়ে করলেন। মায়ের সন্দেহ সত্যি হয়ে গেল কাগজে-কলমে। বাবার সঙ্গে মায়ের ডিভোর্স হয়নি, তাই মা বিয়ে করলেন না। আমার মধ্যে তাঁর বেঁচে থাকার নিঃশ্বাস খুঁজে পেলেন। সাল ১৯৮৫। আমাকে কোলে করে নদীপথে নিয়ে আসছেন সিলেটে। নদীর ঘোলা পানি হলো মায়ের প্রথম খাবার। মা খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলেন আমাকে কী খাওয়াবেন, কোথায় রাখবেন, কীভাবে বড় করবেন। নানুর একচালা টিনের বাসাই শেষ আশ্রয়স্থল। নানু আশ্বস্ত করলেন, ‘আমি দুবেলা খেলে তুইও দুবেলা খাবি।’ শুরু হলো আমাকে বড় করার সংগ্রাম।
মামলা ঠুকে দেওয়া হলো বাবার বিরুদ্ধে। আমাকে তাঁর নিজের কাছে রাখতে মা সব চেষ্টাই করে গেলেন। নানাবাড়ির কেউই গরিব নয়। খালারা লন্ডন থাকেন বিধায় মাকে বিয়ে দিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন। আমার দিকে তাকিয়ে মা রাজি হলেন না।
মা কারও কাছে হাত পাততে রাজি নন। তিন-চারটি টিউশনি শুরু করে দিলেন, যার সর্বমোট মাত্র ২০০ টাকা প্রতি মাসে। সমাজের কিছু মানুষ তা মেনে নিতে পারল না। ‘দুই বছর পার হয়নি স্বামীর ঘর করতে পারল না, এখন বেপর্দা হয়ে বাসায় বাসায় টিউশনি করছে’ বলে হাসি, ঠাট্টা, বিদ্রূপ শুরু হয়ে গেল। মা নীরবে সব সহ্য করে নিলেন। আমাকে যে বড় করতেই হবে তাঁর।
দেখতে দেখতে আমি সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হলাম। খাতা-কলম আর আমার আইসক্রিম মিলে খরচ কিছুটা বেড়ে গেল মায়ের। আয় তো বাড়াতেই হবে। কাঁথা সেলাইসহ টেইলার্সের কিছু বাড়তি কাজও শুরু করে দিলেন। সামনে ঈদ। এখন মাস শেষে ৪০০-৫০০ টাকায় খরচ চালিয়ে কিছু টাকা সেভিংস করাও যাচ্ছে।
মা অবসর সময়ে আমাকে পড়াতেন। আমি সেই পড়ালেখায় পঞ্চম শ্রেণী পাস করলাম। মা আর পারছেন না। আমাকে নিজে থেকেই এখন বুঝে-শুনে পড়তে হবে। এমন সময় স্বর্গের দূত হয়ে আবিষ্কৃত হলেন আবদুর রহমান স্যার। আমার পড়ালেখা দেখে তিনি আমাকে বিনা বেতনে পড়ানোর জন্য মাকে অনুরোধ করলেন। মা রাজি হলেন না। এদিকে স্যারও নাছোড়বান্দা। অবশেষে টাকার বদলে সকালের নাশতা আর স্যারের কিছু খরচ চালিয়ে গেলেন। অষ্টম শ্রেণীতে এসে অনুভব করলাম, আমাকে কিছু শুরু করতেই হবে। মা বললেন, ‘তোকে পড়ালেখা করতে হবে আগে। রোল নম্বর ১০-এর মধ্যেই থাকতে হবে। যদি পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু করিস, তাহলে ঠিক আছে।’ জীবনে সব সময় ৫-এর মধ্যেই রোল নম্বর ছিল, একবার শুধু ১০-এর কোঠার শেষ প্রান্ত স্পর্শ করেছিল। ভয়ও পেয়ে ছিলাম তখন। শুরু করে দিলাম পড়ালেখার পাশাপাশি বাচ্চাদের অ আ ক খ শেখানো।
এসএসসি পাস করলাম ফার্স্ট ডিভিশন নিয়ে। মায়ের চোখে সুখের জল। খুশিতে মা মিষ্টি বিতরণ করলেন পাড়ায়। আমি নিজেই নিজের খরচ চালানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম। তবু মা টিউশনি চালিয়ে গেলেন। বাবার কথা জিজ্ঞেস করতে আগে অনেকবার তিনি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। ১৮ বছর পূরণ হতেই কাবিননামা বের করে দেখালেন, ‘এই হচ্ছে তোর বাবার ঠিকানা, তুই বেজন্মা না। তোর বাবা বেঁচে আছে আজও। তার কাছে যেতে ইচ্ছে করলে যেতে পারিস।’
২০০১ সালে এসে বাবার সন্ধান পেলাম। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী মারা গেছেন ততক্ষণে। বাবা আমাকে রেডিমেড পেয়ে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লেন। আমি দেখতে পেলাম আমার রক্তের দু-তিনটে ভাইবোনও আছে। বাবা অতীত নিয়ে প্রশ্ন করতে না করলেন। আমি সমাধান চাইলাম। আমার মায়ের সম্মানটুকু ফিরিয়ে আনতে চাইলাম। বাবা সমাজের ভয়ে দিতে পারলেন না।
বাবাকে পেয়ে আবারও হারিয়ে ফেললাম। মায়ের কাছে ফিরে এসে কান্নায় ভেঙে পড়লাম।
: আমি হেরে গেছি মা, তোমার সম্মানটুকু ফিরিয়ে আনতে পারলাম না।
: তুই বড় হ বাবা। তুই বড় হলেই আমার সম্মান।
: মা, তুমি দেখো, একদিন এই পৃথিবী দাঁড়িয়ে তোমাকে সম্মান জানাবে।
গতকাল রাতে আমি ঘুমোতে পারিনি। পুরো অতীত যেন আমার চিন্তার বৃত্তের কেন্দ্রে ঘুরপাক খাচ্ছিল। মায়ের একমাত্র সেই ছেলে আমি। বড় হওয়ার জন্য দেশে গণিতে মাস্টার্স শেষ করে লন্ডনে এসে এমবিএ শেষ করলাম। বিলেতের মতো জায়গায় অ্যাকাউন্টসে জব করে এখন অনেক টাকাও রোজগার করছি। মানবতার কাজে যতটুকু পারছি নিয়োজিত রাখছি। সমাজের বিদ্রূপকারীরা আজ অনেকেই মাকে বাহবা দিচ্ছে। সফল নারী বলছে। তবু মা প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছেন, ‘তুই এখনো বড় হতে পারিসনি, বাবা। মনের দিক দিয়ে আরও বড় হতে হবে তোকে। অনেক বড়। সেটাই হবে আমার সম্মান।’
আরাফাত তানিম
লন্ডন, যুক্তরাজ্য