মোটামুটি

সবার মতো আমিও একজন আদর্শ মানব হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, শেষ পর্যন্ত হয়েছি একজন আদর্শ ‘দানব’। অনেকে বলেন, পরিশ্রম, একাগ্রতা, অধ্যবসায় ছাড়া কোনো কিছু হয় না। ভুল কথা। বর্তমানে আমি যে অবস্থানে আছি, তা অর্জন করার জন্য আমাকে কোনো পরিশ্রমই করতে হয়নি। শুধু খেয়েছি (খাওয়াটা তো আর কোনো পরিশ্রম নয়, শান্তির একটা ব্যাপার)। খুব যে বেশি খেয়েছি, তা-ও না। পরিমাণে কিছু এদিক-সেদিক হতে পারে, সে তো সবারই হয়। বাসায় সবার খাওয়ার পরিমাণ কি এক হয়? হয় না। আমাদের বাসায়ও তা-ই। সকালে বাবা তিনটা পরোটা খান, মা খান দুটো, আমি আট-দশটা। এটা কি খুব বেশি কিছু? ভাত খাওয়ার সময় মা যখন বলেন, ‘আরেকটু দেব?’ আমি ‘না’ করতে পারি না। মায়ের কথা ফেলি কী করে? যদিও ওজনটা সেঞ্চুরি পেরিয়েছে অনেক আগেই, এখন আর মাপি না। বন্ধুরা বলে, ‘ঢাকার আয়তন বাড়ে না, কিন্তু তোর ওজন-আয়তন দিন দিন বাড়ছে...এভাবে যদি আমার ফেসবুকের লাইক বাড়ত...!’
মা–বাবা আমার নাম রেখেছিলেন জায়ান। তবে আমার নাম হয়ে গেছে ‘জায়ান্ট’। বন্ধুরা আদর করে নাম দেবে, এটাই স্বাভাবিক। ক্লাসে তমা নামের একটা মেয়ে এসেছে এই সেমিস্টারে। সে-ও বেশ ওজনদার। সবাই তার নাম দিয়েছে টমাটো। যদিও সব রসিকতা আমাকে নিয়েই হয়। আমি নাকি এতই মোটা যে, পুরো ছবি প্রোফাইল পিকচারে আঁটে না, অর্ধেক কাভার ফটোতে চলে যায়। আমার ফেসবুক প্রোফাইলও নাকি বেশ ভারী। লোড হতে সময় বেশি নেয়। ইফতি বলে, কয়েক দিন পর আমার ছবি তোলার জন্য নাকি প্যানারোমা অপশন ব্যবহার করতে হবে।
তবে ওরা যে আমাকে অপছন্দ করে, তা-ও নয়। সব সময় পাশে চায় আমাকে (বিশেষ করে আন্তবিভাগীয় মারামারি আর পরীক্ষার সময়)। মিডটার্ম বা ফাইনালে আমার পেছনে বসার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা হয়। আমার পেছনে বসে নকল করলে টিচাররা দেখতে পান না। তবে আমার সূক্ষ্ম ধারণা, মেয়েরা বোধ হয় আমাকে অপছন্দই করে। সেদিনও সামনের বেঞ্চে বসে নোট লিখছি, পেছন থেকে রিপা বলল, ‘আমার পাশে এসে বস।’ ওর পাশে বসতেই রিপা বলল, ‘তুই সামনে বসলে ব্ল্যাকবোর্ড দেখা যায় না। পেছনে বসবি।’
মুনা সেদিন বলছিল, ‘শুধু তোর জন্য আলাদা একটা লিফট দরকার। তুই থাকলে লিফটে উঠতে ভয় লাগে।’
আমার এই দানবাকৃতির জন্যই তিথি অন্য ব্যাচের সঙ্গে ক্লাস করে। গত সেমিস্টারে প্রেজেন্টেশনে এক গ্রুপেই ছিলাম আমরা। আমি অবশ্য ভেবেছিলাম, ও সকালে উঠতে পারে না বলে অন্য ব্যাচে গেছে। পরে শুনলাম, ঘটনা তা নয়। কেউ যখন বলত, ‘তোকে জায়ান্টের সঙ্গে দেখলাম, জুস খাচ্ছিস...জায়ান্ট কি তোর বয়ফ্রেন্ড?’ তখন নাকি সে অপমানিত বোধ করে বলত, ‘না না, কী বলিস! আমরা একসঙ্গে পড়ি আরকি...।’ আসলে ওরও দোষ নেই। এ যুগে প্রদর্শনযোগ্য না হলে বিরাট বিপদ। তা ছাড়া আমাকে নিয়ে আসলেই ওর অনেক সমস্যা হতো। আমার সঙ্গে রিকশায় ঘোরা যায় না, সবচেয়ে বড় কথা, রাস্তায় বেরোলে সবাই তাকিয়ে থাকে। অনেকে নাকি ‘মোটু পাতলু’ বলে খ্যাপায় ওকে। এতে খ্যাপার কী আছে কে জানে!
তিথির ধারণা, ওজন কমানো নিয়ে আমার কোনো চিন্তাই নেই। ভিত্তিহীন অভিযোগ। আমি রোজ হাঁটি (না হেঁটে উপায় কী? লেগুনা, বাস—কোনোটাতেই তো আমি বসতে পারি না)। কিন্তু একা হাঁটতে ভালো লাগে? তিথি হাঁটতে চাইত না। রাস্তার ধুলায় তার অ্যালার্জি। কোনো পার্কে যে বসব, সেই উপায়ও নেই। বড় করে লেখা থাকে, ‘সন্ধ্যার পর পার্কে বসা নিষেধ’। বাধ্য হয়ে রেস্টুরেন্টে বসতাম। দীর্ঘক্ষণ কিছু না খেয়ে বসে থাকা খারাপ দেখায়। তখন খাবারের অর্ডার দেওয়া হতো। মুটিয়ে যাওয়ার ভয়ে অরেঞ্জ জুস ছাড়া কিছু খেত না তিথি। শেষে খেতে হতো আমাকেই। তো, আমি মোটা না হলে কে হবে? তা ছাড়া আমিও তো একটা মানুষ। মাঝে মাঝে আমারও মোরগ পোলাও কিংবা কাচ্চি খাওয়ার ইচ্ছে হতেই পারে। তাই ইচ্ছা হলে বাসার পাশের দোকানটায় একটু বিরিয়ানি খাই। অন্যরাও খায়। কিন্তু কেন যেন আমিই একটু বেশি মোটা।
আমার কী দোষ? বেঁচে থাকার জন্য সবার মতো আমিও খাদ্য গ্রহণ করি। হয়তো অন্যদের চেয়ে একটু বেশি খাই। কী করব? খেতে খুব ভালো লাগে। আর জ্ঞানীরা তো বলেছেন, ‘সেই কাজটাই করো, যেটা তোমার ভালো লাগে।’ জ্ঞানীদের কথা তো ফেলে দেওয়া যায় না। তা ছাড়া মোটা হওয়া তো কোনো অপরাধ নয়। বাংলাদেশের সংবিধানে মোটা হওয়ার ব্যাপারে কোনো বিধিনিষেধ নেই। এই সহজ ব্যাপারটাই তিথিকে বোঝাতে পারিনি। ও বলত, ‘তুমি স্লিম হতে পারো না?’ কী বিপদ। এ তো বিশালতার তাত্পর্যই বোঝে না। বড় কিছু দেখলে যে মন বড় হয়, মনীষীদের এই কথা কে না জানে? ওকে বোঝাই, ‘মানুষ চিকন হয়, মোটা হয়, বডিবিল্ডার হয়। কিন্তু মনটাই আসল।’ তিথি আমার কথার গুরুত্ব দেয়নি। আজ সে আর আমি একই ভার্সিটির ভিন্ন ব্যাচে ক্লাস করি। মাঝে মাঝে এটা ভেবে মন খারাপ হয়। মন খারাপ হলে আমি কিছু না কিছু খাই। ফলস্বরূপ ওজন আগের চেয়েও খানিকটা বাড়ে।
তবে আজ যেহেতু ও ক্যানটিনে দেখা করতে বলেছে, তখন নিশ্চয়ই ওর রাগটা কোল্ড ড্রিংস হয়ে গেছে। ক্লাস শেষে ক্যানটিনে গিয়ে তিথিকে খুঁজে বের করলাম। তারপর একটা বার্গার নিয়ে টুলে বসে পড়লাম আমি। এ-কথা সে-কথার পর তিথি বলল, ‘কথাটা কীভাবে নেবে, তা বুঝতে পারছি না। তুমি কি এবারও কোনোভাবে আমার অ্যাসাইনমেন্টটা করে দিতে পারবে?’
কিছু বলার আগেই হঠাৎ কোনো ঘোষণা ছাড়াই আমার প্লাস্টিকের টুলটা জনসমক্ষে ভেঙে পড়ল। ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেলাম আমি আর আমার বার্গার। উচ্চ স্বরে হেসে উঠল আশপাশের সবাই। একজন বলল, ‘কেউ হইচই করিস না, ভূমিকম্প হচ্ছে না। আমাদের জায়ান্ট টুল ভেঙে পড়ে গেছে।’ কেউ আমাকে তুলতেও এল না (এলে লাভও হতো না অবশ্য)। তিথি কিছু না বলেই ঘুরে চলে গেল। আমি হতভম্ব, কী করব বুঝতে পারছি না। এমন সময় বেশ হইচই শুরু হলো চারপাশে। টের পেলাম ফ্লোর দুলছে। খুব হতাশ লাগল। আমি কি এতই মোটা যে পড়ে গিয়ে ফ্লোর কাঁপিয়ে ফেললাম? পরে দেখি সবাই ‘ভূমিকম্প! ভূমিকম্প!’ বলে চিত্কার করতে করতে হুড়মুড় করে নিচে নামার চেষ্টা করছে। মুহূর্তের মধ্যে ক্যানটিন খালি হয়ে গেল। মনে হলো পুরো ভার্সিটি আমার মাথায় ভেঙে পড়বে। কয়েক সেকেন্ড পর ভূমিকম্প শেষ। ধাতস্থ হয়ে উঠে দেখি আমাদের ক্লাসের টমাটো, মানে তমা নিশ্চিন্তে বসে বসে বার্গার খাচ্ছে। আমি হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি নিচে নামলে না?’
: ইয়ে...আবার খাবার রেখে নামব, ঝামেলা না?
খুব মজা পেলাম আমি। এ তো একেবারেই আমার ভাবধারার মানুষ। আমাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে তমা বলল, ‘টুল ভেঙে তুমি তো পড়লেই, তোমার বার্গারটাও পড়ল। আরেকটা দিতে বলব?’
‘বলো।’ সানন্দে রাজি হলাম। ওর সামনে বসে বললাম, ‘আমি আসলে জাতিসংঘের মতো। জাতিসংঘ শিশুদের হ্যাঁ বলে, আমি বলি খাবারকে।’ তমা বার্গারে বড় এক কামড় বসিয়ে বলল, ‘আমিও।’
বার্গার আর কোমল পানীয় এল। সেই সঙ্গে ভূমিকম্পের সময় নিচে যারা ছুটে গিয়েছিল, ফিরে এল তারাও। এসে অবাক হয়ে দেখল, আমরা দুজন বার্গার খাচ্ছি। জয় বলল, ‘কী রে ভাই, তোরা এখানে বসে আছিস, নিচে নামলি না?’ তমা খেতে খেতে বলল, ‘আমরা দুজন দৌড় দিয়ে নামতে গেলে সত্যি সত্যি বিল্ডিংটা হেলে পড়ত।’
আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। সেদিন থেকে তমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্যানটিনে (যেহেতু আমরা খেতে খুব ভালোবাসি) দেখা যায় আমাদের। টিউশন ফি জমা দিতে আগে একাই হেঁটে হেঁটে ব্যাংকে যেতাম। এখন তমাও থাকে। খাওয়াদাওয়াও চলছে, তবে আগের চেয়ে অনেক বেশি হাঁটি আমরা (না হেঁটে উপায়ও নেই, দুজন মিলে রিকশায় ওঠা রিকশাচালকের প্রতি অন্যায় হয়ে যায়)। রাস্তার ধুলায় তমার অ্যালার্জি নেই। আমার তো আগেও ছিল না। তা ছাড়া মোটাদের কষ্ট সবচেয়ে ভালো বোঝে মোটারাই। কেউ যখন জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে, কেমন আছিস?’ দুজনই বলি, ‘এই তো, মোটামুটি ভালোই আছি।’