১৮ আগস্ট গণভবনে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ছেলেরা বাইরে ঘোরাঘুরি করে, দুষ্টুমি করে। এ কারণে বেশি পড়াশোনা করতে চায় না। খেলাধুলা করতে হবে। দুষ্টুমিও করতে হবে।
আর্ট-কালচারে সমৃদ্ধ হতে হবে। কিন্তু সবকিছুর পর পড়াশোনা করতেই হবে।’ (সূত্র: প্রথম আলো, ১৮ আগস্ট ২০১৬)
ছেলেরা যদি এভাবে পিছিয়ে পড়তে থাকে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে কেমন হতে পারে মীনা-রাজুর গল্পটা?

প্রতিদিনের মতো মোতালেবের চায়ের দোকান থেকে বেস্ট ফ্রেন্ড দীপুর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরছিল রাজু। সঙ্গে ছিল তার সব সময়ের সঙ্গী টিয়াপাখি মিঠু। বাড়ি ফেরার পথেই গ্রামের স্কুল। সেখানে ক্লাস চলছে, বাইরে থেকে স্কুলের আপার গলা শোনা যাচ্ছে। ওই স্কুলেই পড়ে রাজুর বোন মীনা। সে খুব ভালো ছাত্রী, মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করে। কখনোই ক্লাস মিস দেয় না। মীনার সঙ্গেই স্কুলে পড়ে মীনার বান্ধবী আর রাজুর ক্রাশ রীতা। রাজু ভাবল, অনেক দিন সে রীতাকে দেখে না। দেখার উপায় নেই, ফেসবুকেও রীতা রাজুকে ব্লক করেছে। রাজু মিঠুকে বলল, ‘চল, স্কুলের জানালা দিয়া উঁকি মাইরা কিছু পড়াশোনা শিইখা আসি।’ মিঠু বলল, ‘পড়াশোনা, পড়াশোনা।’
রাজু স্কুলের জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল। ওই যে ভেতরে মীনার পাশেই রীতাকে দেখা যাচ্ছে। অঙ্ক ক্লাস, আপা দুইয়ের ঘরের নামতা শেখাচ্ছেন।
‘হ্যাঁ, বাচ্চারা, আমার সাথে সাথে বলো, দুই এক্কে দুই, দুই দু-গুণে চার, তিন দু-গুণে ছয়...।’
ছাত্রছাত্রীরা আপার সঙ্গে গলা মিলিয়ে নামতা পড়তে লাগল। তাদের সঙ্গে তাল মেলাল মিঠুও। রাজু এসব খেয়াল না করে রীতার দিকে মনোযোগ দিয়ে রেখেছিল। মিঠুর গলা শুনে সবাই জানালার দিকে উৎসুক হয়ে তাকাল। একটা ছেলে আঙুল দিয়ে দেখাল, ‘দ্যাখ দ্যাখ, একটা টিয়াপাখি!’

রাজু খেল ধরা! মিঠুকে নিয়ে সে জানালার পাশ থেকে কোনোরকমে পালাল। বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় সে মিঠুকে একচোট বকেও দিল, ‘এই সব আলতুফালতু নামতা-টামতা শেখার মানে কী? দিছিলি তো ধরা খাওয়াইয়া। এই নিয়া কতবার তোর কারণে ধরা খাইতে গেছি হিসাব আছে তোর?’ মিঠু বলল, ‘দুই দু-গুণে চার!’
রাজু আরও বিরক্ত হলো। ভাবল, কোনোভাবে স্কুলে পড়ার সুযোগ পাওয়া গেলে পড়াশোনা হোক না-হোক, রীতার সঙ্গে খাতির জমিয়ে ফেলা যেত!
ঘরে ফেরার সময় বাড়ির কিছু সামনেই রাজুদের মুরগিগুলো রাখা। রাজু মুড ভালো করার জন্য মুরগিগুলো ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে একটা সেলফি তুলে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করল। ক্যাপশন দিল, ‘#our_chickens, #with_my_pet_mithu, #hangout’।
রাতের বেলা, সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে। রাজুর সেই রকম খিদে পেয়েছে, আজকে সন্ধ্যায় মোতালেবের দোকানের ফুচকাটা খাওয়া হয়নি। রাজুর মা তার প্লেটে আজকেও ‘একটা’ অর্ধেক ডিম তুলে দিলেন, আর অন্য দিনের মতোই মীনাকে দিলেন একটা আস্ত ডিম। রাজু বলল, ‘মা, আইজকা আমারে একটা আস্ত ডিম দেও।’ মা কঠিন গলায় বললেন, ‘তুই কি মীনার মতো লেখাপড়া করস যে তোরে আস্ত ডিম দিতে হইব? সারা দিন আড্ডা দেস আর ঘুইরা বেড়াস, ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান্স খেইলা দিন পার করস, ফেসবুক থেইকা তো চোখই সরাস না। তোর এত খাওনের কী দরকার!’ রাজু করুণ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘মা, আমিও স্কুলে পড়বার চাই!’ দাদি বললেন, ‘হ, মীনার মা, রাজুরেও কিন্তু মীনার সাথে স্কুলে পড়তে দেওয়া উচিত।’ বাবা বললেন, ‘হ, ওরেও তো এই সব দুষ্টামি বাদ দিয়া লাইনে আনন দরকার, কিন্তু স্কুলে পড়লে তো টাংকি মারা ছাড়া আর কিছু করব না। ও একদিন এই সব দুষ্টামি বাদ দিয়া একটা কামের কাম করুক, তাইলে ওরে স্কুলে পড়তে দেওয়া যাইতে পারে।’
রাজু সেদিন সারা রাত ভাবল, তাকে কিছু একটা ‘কামের কাম’ করতেই হবে। সেদিন সারা রাত সে ফেসবুকে ঢুকল না, ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান্স খেলল না, কারও মেসেজের রিপ্লাইও দিল না। শুধু একটা স্ট্যাটাস দিয়ে ফেসবুক থেকে বের হয়ে গেল, ‘feeling determind!’
পরদিন সকাল। মীনা আর রীতা একসঙ্গে স্কুলে যাচ্ছে। রাজু বাড়ির সামনে বসে সেদিকে তাকিয়ে মোবাইল ফোন হাতে উদাস নয়নে ফেসবুক হোমপেজ স্ক্রল করছে।
সে সময় ঘটল আরেক ঘটনা। গাছের আড়াল থেকে চুপিচুপি বেরিয়ে এল এক মুরগিচোর। মুরগিগুলোর মধ্যে একটা মুরগি নিয়ে সে দৌড়ে পালাল চুপচাপ। রাজুর চোখ ছিল হোমপেজে, সে এসবের কিছুই দেখল না। হুট করে মিঠু চেঁচিয়ে উঠল, ‘চোর, চোর!’ রাজু ফোন থেকে চোখ সরিয়ে মুরগিগুলোর দিকে তাকাল। হ্যাঁ, মুরগি কেমন কম কম লাগছে। সে গতকাল ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা ছবিটা খুলে দেখল, হ্যাঁ, সত্যিই তাই! ব্যাকগ্রাউন্ডে ছয়টা মুরগি ছিল। এখানে মুরগি আছে পাঁচটা। সে দ্রুত পদক্ষেপ নিল, স্ট্যাটাস দেওয়ার জন্য ঢুকল ফেসবুকে। ঢুকেই সে অবাক! চোর তো তার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে, মাত্রই স্ট্যাটাস দিয়েছে ‘ওয়ান মোর মুরগি ক্যাপচার্ড, ফিলিং হ্যাপি!’
রাজু দ্রুত গ্রামের ময়মুরব্বিদের ডাক দিয়ে চোরের ফেসবুক ইনফো ঘেঁটে তার ঠিকানায় পৌঁছে গেল। পৌঁছেই তারা মুরগিসহ হাতেনাতে ধরে ফেলল চোরকে। গ্রামের মোড়ল আর গ্রামবাসী—সবাই জিজ্ঞেস করল রাজুকে, কী করে সে টের পেল মুরগি চুরির কথা। রাজু প্রথমে ভাবল, সে সেলফির কথা বলবে, পরে ভাবল, স্কুলে ভর্তি হওয়ার এটাই সুযোগ! সে বলল, স্কুলের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে সে নামতা শিখে নিয়েছিল। পরে নামতা পড়ে মুরগি গুনে দেখেই চুরির ব্যাপারটা বুঝতে পারে।
মোড়ল আর গ্রামবাসী খুব খুশি হলো রাজুর ওপর। মোড়ল রাজুর বাবাকে বললেন, ‘মীনার পাশাপাশি রাজুরেও তোমার স্কুলে পড়ানো উচিত। একটু দুষ্টু হইলেও পোলাটা ট্যালেন্ট আছে!’ বাবা রাজুকে খুশি হয়ে বললেন, ‘আইজ থেইকা তুমিও স্কুলে যাইবা, রাজু!’
রাজু আনন্দে চিৎকার করে উঠল, ‘হাছা কইতাছো, বাজান?’
‘হ রে বাপ, হাছা কইতাছি!’
রাজু এখন মীনার সঙ্গেই স্কুলে যায়। পড়াশোনা তেমন না করলেও, রীতার সঙ্গে খাতিরটা সে বেশ জমিয়েই ফেলেছে!