
ভদ্রলোকের (যদিও তাকে কোনোভাবেই ভদ্রলোক বলা উচিত হচ্ছে না, তবু ভদ্রতার খাতিরে বলতে হলো) দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটার জন্য কোনো লাইক পাব না?’
: নাহ্।
: আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না?
: না রে, ভাই। শুধু আমি কেন, আমার বউও আপনার কথা বিশ্বাস করবে না।
: এর মধ্যে আবার বউকে আনছেন কেন?
: কারণ, উনি আমাকে ছাড়া সবাইকে বিশ্বাস করেন।
কথাটা বলেই খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসতে লাগল লোকটা। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ব্যাগে ঢোকালাম দুই টাকার নোটটা। তারপর বেশ জোরে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে বাইরে এলাম। রিসিপশনিস্ট কড়া গলায় বললেন, ‘কী ব্যাপার, এভাবে ধাক্কা দিলেন যে?’
‘দরজার গায়েই লেখা আছে—ধাক্কা দিন।’ কড়া গলায় বললাম আমি। আসলে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে। এত দূর থেকে এসেও কোনো কাজ না হলে যেকোনো সুস্থ মানুষেরই মেজাজ খারাপ হয়।
আমি এসেছিলাম মিরপুরের টাকা জাদুঘরে। দাদার আলমারি ঘাঁটতে গিয়ে দুই টাকার চকচকে একটা নোট পেয়েছিলাম। ভাবলাম, অ্যান্টিক জিনিস, টাকা জাদুঘরে দিলে বিনিময়ে যদি কিছু লাইক পাওয়া যায়, মন্দ হয় না। ও মা, এসে দেখি এরা আমার কথা বিশ্বাসই করছে না! খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসা সেই কর্মকর্তা তো বলেই বসলেন, ‘ভাই, আমার দাদার জন্ম ২০১৫ সালে। সে–ও কোনো দিন চকচকে দুই টাকার নোট দেখেছে বলে শুনিনি। ২০১৫ সালেও যে কয়টা দুই টাকার নোট ছিল, তার সবই ছেঁড়া, ল্যাবড়া–ছ্যাবড়ামার্কা। আর আপনি এত বছর পর এসে চকচকে দুই টাকার নোট দেখিয়ে বিশ্বাস করতে বলছেন?’
ভাবটা এমন, যেন আমি নিজেই টাকা বানিয়ে এনেছি। আরে কাগজের টাকা যে অনেক আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তা তো আমিও জানি। কোনোভাবে হয়তো এই দুই টাকার নোটটা বেঁচে গেছে। হতেও তো পারে। শুধু শুধু আসলাম। তবে জাদুঘরটা দেখে ভালো লাগল। মানুষ আগে কীভাবে টাকা নিয়ে ঘুরত, কে জানে? টাকা রাখার জন্য মানিব্যাগ, ব্যাংক কত কিছু! এখন ওসব ঝামেলা নেই। টাকা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিনিময়ের মাধ্যম এখন ফেসবুকের লাইক। সবকিছু লাইক দিয়ে কেনা হয়। সমাজে যার লাইক বেশি, তার ক্ষমতাও বেশি। ‘লাইক যার, মুলুক তার’ টাইপ অবস্থা।
এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই বাসে উঠলাম। সিটে বসতে না বসতেই সামনের স্ক্রিনে লেখা উঠল, ‘ভাড়া দেন।’ মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। ঠিকমতো বসতে পারলাম না, এখনই ভাড়া চায়! ফোনটা বের করে ১০টা লাইক পাঠিয়ে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বিপবিপ আওয়াজ। স্ক্রিনে লেখা, ‘কত দিলেন? আরও ১০ লাইক দিবেন তো।’ মেজাজ আরও গরম হয়ে গেল। থাবড়া দিয়ে ‘ক্যানসেল’ বাটনটা চাপলাম আমি। এতেই কাজ হবে, ব্যাটা কম্পিউটার ঠিকই বুঝে নেবে আমি স্টুডেন্ট!
আবার ভাবতে শুরু করলাম। এই নোটগুলো মানুষ সঙ্গে রাখত কী করে? নিশ্চয়ই হারিয়ে যেত। কিংবা ভিজে নষ্ট হতো বৃষ্টিতে। এক হাজার টাকার নোটও তো ছিল। একটা নোট কোনোভাবে ড্রেনে পড়ে গেলেই তো শেষ! কী ভয়ংকর ব্যাপার! সে সময়ের মানুষগুলোর জন্য মায়াই হলো আমার। এখন কত সুবিধা। সবারই ফেসবুক আইডি আছে। এটাই এখন জাতীয় পরিচয়পত্রের কাজ করছে (কদিন আগে ফেসবুক আইডিহীন কয়েকজন সন্দেহভাজনকে আটকও করেছে পুলিশ)। ফেসবুক অ্যাকাউন্টে সবার লাইক জমা থাকে। সেই লাইক দিয়েই হয় কেনাকাটাসহ যাবতীয় কাজ। বেতন পায় ফোনে, লাইকও পাঠায় ফোনে। তাই লাইক কামানোর জন্য ছুটছে মানুষ। যে যেভাবে পারছে, লাইক জোগাড়ের চেষ্টা করছে। কেউ লেখে, কেউ গান গায়, কেউ করে ব্যবসা কিংবা চাকরি। লাইক না থাকলে জীবন চলবে কীভাবে?
অবশ্য প্রয়োজনে অন্যের কাছ থেকে লাইক ধারও নেওয়া যায়। কদিন আগেই ৪০ হাজার লাইক ধার নিয়ে একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা কিনল জিশান। ডিএসএলআর ক্যামেরা থাকলে নাকি প্রোফাইল পিকচার তুলে ভালো লাইক পাওয়া যায়। এখন মাসে যা লাইক পাচ্ছে, তা দিয়ে সেই টাকা শোধ করছে সে। ভাবনায় ছেদ পড়ল পাশের যাত্রীর কথায়। ফোনে কাকে যেন বলছেন, ‘আরে ভাই, লাইকের কথা আর বইলেন না। সৎপথে থেকে লাইক কামানো আজকাল কঠিন হয়ে পড়েছে। বেতনের লাইক দিয়ে সংসারই চলে না ঠিকমতো, আবার ঘুরতে যাব কী?’
ঠিকই বলেছে লোকটা। সামান্য কিছু লাইকের জন্য মানুষ যে কত নিচে নামছে, কল্পনা করা যায় না! সেদিন এক ই-পেপারে পড়লাম, নাখালপাড়ায় অস্ত্রের মুখে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১০ লাখ লাইক ছিনিয়ে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
হঠাৎ বাস থেমে গেল। বাস থামিয়েছেন একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট। বাসের চালক স্টার্ট বন্ধ করে নিচে নেমে গেলেন। ফিরে এলেন কিছুক্ষণ পরই। সামনের সিটে বসা মুরব্বিমতো এক লোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত লাগল?’
‘দুই শ লাইকেই হইয়া গেছে।’ হেসে উত্তর দিলেন চালক।
এভাবেই চলছে দেশ। সবাই লাইকের পেছনে ছুটলে তো এমন হবেই। আসলে লাইকই সব অলাইকের মূল। কী করা যায় ভাবছিলাম, এমন সময় রবিনের ফোন।
: দোস্ত, পাঁচ হাজার লাইক দিতে পারবি?
: কেন? তোর অ্যাকাউন্টে না বিশ হাজার লাইক?
: তা আছে। কিন্তু কমপক্ষে ৫০ হাজার লাইক না হলে আজকাল মেয়েরা বিয়েতে রাজি হয় না। এখন তুই দিবি কি না বল।
‘লাইক দিতে পারব না’ বলে কেটে দিলাম ফোন। বাস থেকে নামতেই অনূর্ধ্ব চৌদ্দ ভিক্ষুক দলের এক সদস্যের কবলে পড়লাম। মেয়েটা হাত ধরে টানতে টানতে বলল, ‘ভাই, কয়ডা লাইক দেন না...দিবেন কয়ডা লাইক?’
‘ওই, নিয়ন! লাইক দে।’
চমকে উঠে দেখি ক্লাসরুমে বসে আছি। ধুর, কী সব অদ্ভুত স্বপ্ন যে দেখি আজকাল! ইকোনমিকস ক্লাস। তমিজউদ্দিন স্যার টাকার বিবর্তন নিয়ে লেকচার দিয়েই যাচ্ছেন। ওদিকে আমার হাত ধরে টানছে পাশে বসে থাকা তমা, ‘ওই নিয়ন, ওঠ।’ আমি চাপা গলায় গর্জে উঠলাম, ‘কী সমস্যা তোর?’
: তুই ক্লাসে ঘুমাচ্ছিলি।
: ক্লাস তো ঘুমানোরই জায়গা। দেশের ৭৭ ভাগ শিক্ষার্থী ক্লাসে ঘুমায়।
: আজাইরা! তোর ঘুমানোর ছবিটা ফেসবুকে আপ করেছি। তাড়াতাড়ি লাইক দে।
: অসম্ভব!
: এক্ষণ লাইক দে, নইলে হাঁ করে ঘুমানোর ছবিটাও আপ করব।
কী যন্ত্রণা! এই স্বপ্নগুলোই দ্রুত বাস্তব হয় কেন? আমি আবার ভাবনার জগতে চলে গেলাম (খেয়াল করে দেখেছি, ইকোনমিকস ক্লাসেই কেন যেন গভীর চিন্তাভাবনা আসে)। ওদিকে তমা ক্রমাগত কথা বলেই যাচ্ছে, ‘কি রে, এখনো লাইক দিলি না? লাইক দিবি কি না বল...’
তমিজউদ্দিন স্যার আর তমা—এরা একবার কথা শুরু করলে আর থামে না।