লাইক মানেই কি লাইক?

তিন বন্ধু৷ মিলি, পিয়াল আর নীলা৷ ভার্চুয়াল জগতে মিলির সবকিছুতেই লাইক দেয় পিয়াল৷ পিয়ালের সবটায়ও মিলির লাইক৷ নীলার ক্ষেত্রেও তা-ই৷ তবে পিয়ালের লাইক বেশি পড়ে মিলাতেই৷ দুজনের ভাবটাও বন্ধুত্বের গণ্ডি পার হওয়ার পথে৷ ফেসবুকে বসে মিলি কয়েক দিন লক্ষ করে, নীলার ছবি, নীলার স্ট্যাটাসে পিয়াল লাইকের পর লাইক দিয়েই যাচ্ছে৷ কিছুদিন পর মিলির েক্ষত্রে পিয়ালের লাইক কমে যেতে থাকে, নীলার বেলায় বাড়তে থাকে৷ বাস্তবেও দুজনের দেখাদেখি, ফোনাফোনি বেড়েই চলেছে৷ মিলি তখন নীলার কোনো কিছুতেই আর লাইক দেয় না৷ মন থেকে সায় পায় না সে৷ মিলির আর বুঝতে বাকি থাকে না, পিয়াল শুধু ভার্চুয়াল নয়, বাস্তবেও নীলাকে বেশি ‘লাইক’ করছে৷ সরাসরি জিজ্ঞাসা করলে পিয়াল বলে, ভাচুর্য়াল আর রিয়াল লাইক এক নয়৷ একটার সঙ্গে আরেকটা গুলিয়ে ফেলো না৷ এমনটা যেমন ঘটে, অন্যটাও দেখা যায়৷ বাস্তবের পছন্দ-অপছন্দের প্রকাশ ঘটে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে, মূলত ফেসবুকে৷
অভিধান পড়ে আমরা জানি, লাইক মানে পছন্দ৷ কিন্তু এই পছন্দকেও ছাপিয়ে গেছে বৃদ্ধাঙ্গুল তুলে দেখানো নীল-সাদা প্রতীকটি৷ মানে ফেসবুকের লাইক চিহ্ন৷ এই একুশ শতকে এসে ফেসবুকই যেন সামাজিকতার সমার্থক হয়ে উঠছে৷ যে ভার্চুয়াল জগতে ১২৩ কোটি মানুষের বসবাস সেই ফেসবুক যে অনেক বড় সমাজ, তা বোঝা সহজই [ডিসেম্বর ২০১৩ পর্যন্ত, সূত্র: উইকিপিডিয়া]৷ তাই পছন্দ-অপছন্দের প্রকাশ লাইকেই ঘটে৷
নিজের কথাই বলি৷ খুব সুন্দর একটি ছবি তুলে দিলাম ফেসবুকে৷ দিয়ে তো আর তর সয় না, কখন প্রথম লাইকটা পাব৷ ঘড়ির দিকে তাকাই আর ফেসবুক দেখি৷ আশপাশের সহকর্মী-বন্ধুদের বলি, ‘এই লাইক দিচ্ছ না কেন?’ আসলে লাইক বেশি না পেলে যে ভালো লাগে না৷ কেউ সত্যিই পছন্দ করে লাইক দেন আবার কেউ বা ‘চাপে পড়ে’ অথবা মন রাখতে লাইক দেন৷ আবার ফেসবুক বন্ধুদের মধ্যে নীরব স্নায়ুযুদ্ধও চলতে থাকে৷ আমার প্রোফাইল ছবিতে লাইক পড়েছে ৩৩৩টা আর রাজীবের ছবিতে ১,৯৯৯টা! আচ্ছা, ওর এতগুলো লাইক কি সত্যি সত্যি লাইক!
দেড়-দুই বছর আগেও বাংলাদেশে ফেসবুকে মানুষের উপস্থিতি বেশি থাকত সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার পর থেকে৷ আবার সাড়ে ১০টার পর থেকে সে হার কমতে থাকত৷ এখন দেখা যায়, রাত ১১টার পর থেকে ফেসবুক বন্ধুদের আনাগোনা বাড়তে থাকে৷ রাত দেড়টা-দুইটা পর্যত্ম থাকে সে ধারা৷ অনেকে এসব সময় হিসাব করেও স্ট্যাটাস বা ছবি দেয় ফেসবুকে৷ ‘সকাল ১০টা বা ১১টায় ছবি দিয়ে পর্যাপ্ত লাইক যদি না পাই!’
সাম্প্রতিক একটি গবেষণা সন্দেহ করছে, ভার্চুয়াল মাধ্যমে দেওয়া লাইক কি মানুষের সত্যিকারের পছন্দের প্রকাশ ঘটায়? নিউ সায়েন্টিস্ট সাময়িকীতে প্রকাশিত একটা নিবন্ধে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কেভিন লুইস ও তাঁর সহযোগীরা বলেছেন, কেউ কিছু পছন্দ করেই লাইক দেয় আবার কেউ কেউ লোক দেখানোর জন্য লাইক দেয়৷ তাদের সিদ্ধান্ত—ফেসবুকের লাইক কোনো বাস্তব পছন্দ বা অঙ্গীকার প্রকাশ করে না৷ ফেসবুকে সেভ দারফুর নামের একটি আন্দোলনের পেজে ২০১০ সাল পর্যন্ত ১২ লাখ লাইক দেখা যায়৷ কিন্তু এত লাইকের বিনিময়ে সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ ছিল মাত্র আট সেন্ট৷ আর ই-মেইলে যোগাযোগ করে সংগৃহীত অর্থ ছিল ১০ লাখ ডলার৷ নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী জেইনেপ টুফেকি বলেছেন, ফেসবুকে প্রতিটি লাইক সমান গুরুত্ব বহন করে না৷
ফেসবুক এখন শুধু সামাজিক যোগাযোগ বা বন্ধু খোঁজার ওয়েবসাইট নয়, দাতব্য প্রচারণা যেমন চলে, তেমনি চলে পণ্যের বিপণন৷ বাণিজ্যিক উদ্যোগ সফল করতেও ফেসবুক বেশ কাজের৷ এখানে লাইক কেনাবেচাও ঘটে৷ আরএমএস আইটির প্রধান নির্বাহী সাজ্জাদ হোসেন জানান, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের জন্য লাইক কেনাবেচা হয়৷ অনেকে টাকার বিনিময়ে কোনো পণ্য বা পেজের কি-ওয়ার্ড মিলিয়ে সেই পণ্যের পেজে লাইক বাড়াতে থাকে৷ অনলাইন আউটসোর্সিংয়ে এ কাজের চাহিদাও বেশ৷ ‘এ ক্ষেত্রে প্রতারণাও হয়৷ অনেকে “বট” বলে পরিচিত বিশেষ প্রোগ্রাম তৈরি করে যেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাইক বাড়াতে থাকে৷’ বললেন সাজ্জাদ৷ এসব ঘটনা ফেসবুক ফ্যানপেজের েক্ষত্রে ঘটে থাকে বেশি৷ আবার এ-ও দেখা যায় কেউ কেউ ফেসবুকে মামুলি একটা স্ট্যাটাস দিলেও কয়েক মিনিটে লাইক পড়ে যায় আট থেকে দশ হাজারের বেশি৷ তখন সেসব বাস্তব লাইক কি না, তা নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধে৷
ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলে লাইক দেওয়ার ব্যাপারটার সঙ্গে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ নির্ভর করে, এমন মনে করেন সাজ্জাদ হোসেন৷ বলেন, ‘মানুষ কোনো স্ট্যাটাস বা ছবি পছন্দ করেই লাইক দেয়৷ ব্যক্তির প্রোফাইলের বেলায় এরকমই ঘটে৷’
এখন অনেক প্রতিষ্ঠানেই চাকরিপ্রার্থীদের ফেসবুক প্রোফাইল পর্যবেক্ষণ করা হয়৷ মানবসম্পদ পরামর্শকেরা মনে করেন, ফেসবুকে কারও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করলে তার মনস্তত্ত্ব বোঝা যায়, আবার তার রুচি সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়৷ ‘লাইক দেখে যায় চেনা’, এমন কথা অনেকের বেলাতেই খাটে৷ আবার নিজেকে জাহির করতে যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত লাইক দেয়, তাদের বেলায় বলা যায়, ‘এই লাইক লাইক নয়, আরও লাইক আছে...৷’