শিশুদের জন্য ডিজিটাল শিক্ষা

পুরোপুরি ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশু আনন্দের সঙ্গেই শিখতে পারে। মডেল: আরোহী, ​ছবি: খালেদ সরকার
পুরোপুরি ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশু আনন্দের সঙ্গেই শিখতে পারে। মডেল: আরোহী, ​ছবি: খালেদ সরকার

সারি সারি ডেস্কে পেটমোটা সব কম্পিউটার। সামনে বসে আছে একদল শিশু। ভাবভঙ্গি গুরুগম্ভীর হলেও উত্তেজনায় চোখ চকচক করছে। আজ নতুন কিছু শিখবে তারা, মজার কিছু। গত শতকের আশির দশকের ঘটনা এটি। তা-ও আবার মার্কিন মুলুকে। স্টিভ জবসের অ্যাপল কম্পিউটার সবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে তিনি একবাক্যে ঘোষণা দিলেন, ‘কিডস কান্ট ওয়েট’। গোটা দুনিয়া কম্পিউটার হাতে এগিয়ে যাবে আর শিশুদের বেলায় বলা হবে ‘আগে বড় হও’, তা চলবে না! ১০-১১ বছরে প্রথম কম্পিউটার দেখেছেন স্টিভ জবস। প্রথম দেখায় প্রেম। আর তাই শিশুশিক্ষায় কম্পিউটারের অন্তর্ভুক্তি ছিল অ্যাপলের অগ্রাধিকার। শিশুদের জন্য মজার মজার সব কম্পিউটার সফটওয়্যার তৈরি করেছে তারা, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কম্পিউটার সরবরাহে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। মোটকথা, শিক্ষা যেন অ্যাপলের ‘ডিএনএ’তেই ছিল।
শনিবার বেসিস সভাকক্ষে আনন্দ কম্পিউটার্সের প্রধান নির্বাহী মোস্তাফা জব্বার পুরোনো স্মৃতি এভাবেই রোমন্থন করছিলেন। সে সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে অ্যাপল কম্পিউটার ইনকরপোরেটেডের সেই উদ্যোগ দেখে অনুপ্রাণিত হন। নিজ দেশে এমন কিছু শুরুর কথা ভাবেন। অ্যাপলের কিছু সফটওয়্যার কিনে আনেন তিনি। বাংলায় রূপান্তরের চেষ্টা করেন। তবে সেই চেষ্টায় সফলতার মুখ দেখে যখন নিজেরা নতুন করে অ্যানিমেশন ও শব্দ সংযোজনার মাধ্যমে এমন সফটওয়্যার তৈরির উদ্যোগ নেন। মূলত সেটাই ছিল বিজয় শিশুশিক্ষা তৈরির ইতিকথা।
এরপর ১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর গাজীপুরে আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল স্থাপন করা হয় পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে। ধীরে ধীরে সারা দেশেই স্কুলের নতুন নতুন শাখা খোলা হয়। এই স্কুলগুলোতে বিজয় শিশুশিক্ষার মাধ্যমে কম্পিউটারভিত্তিক শিক্ষার হাতেখড়ি দেওয়া হয় শিশুদের। এদিকে চলতে থাকে বিজয় শিশুশিক্ষার উন্নয়ন। ২০১১ সাল নাগাদ প্রাক–প্রাথমিক পর্যায়ের শিশুদের জন্য পূর্ণাঙ্গ সফটওয়্যার তৈরি হয়। মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘এরপর আমার স্বপ্ন ছিল স্কুলের বাচ্চাদের হাতে কম্পিউটার পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু ৪০-৫০ হাজার টাকার কম্পিউটার তো আর দেওয়া সম্ভব না। কম খরচের কম্পিউটারের খোঁজে লেগে পড়ি। এদিকে আমাদের সফটওয়্যারের উন্নয়ন চলছেই। প্রিস্কুল পর্বের কাজ হলো, পাঠ্যবই ধরে প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণিও হলো। কিন্তু আমরা চাইছিলাম সফটওয়্যারটি শুধু শ্রেণিকক্ষে না, শিশুদের হাতে পৌঁছে দিতে।’এর মধ্যে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় নেত্রকোনার পূর্বধলার এক স্কুলের অধ্যক্ষের সঙ্গে। সৈয়দ আরিফুজ্জামান নামের সেই অধ্যক্ষের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেন তাঁরা। এরপর গত বছরের শেষে এই প্রচেষ্টার উদ্বোধন করা হয়। মোস্তাফা জব্বার জানান সারা দেশে এই শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়াই এখন আমাদের পরিকল্পনা। এ বছর পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিষয়বস্তু (কনটেন্ট) তৈরি করব আমরা।

পূর্বধলার স্কুলে ডিজিটাল শিক্ষা
নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার আরবান একাডেমির অধ্যক্ষ সৈয়দ আরিফুজ্জামানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিদ্যালয়টির ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথমে বিজয় শিশুশিক্ষার প্রাক্-বিদ্যালয় বিষয়বস্তুগুলো শ্রেণিকক্ষে বড় পর্দায় দেখানো শুরু করি। এতে বেশ ভালো ফল পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীরা আগ্রহের সঙ্গে পড়াশোনা করে।’ এরপর তিনি ভেবে দেখেন, যদি প্রতিটি শিশুর হাতে তা পৌঁছে দেওয়া যায়, তবে আরও ভালো হয়। এর মধ্যে বিজয় শিশুশিক্ষা দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা উপকরণ তৈরি করে ফেলে। এগিয়ে আসে বেসরকারি সংস্থা ডিনেট। ওদিকে মোস্তাফা জব্বার সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে চেষ্টা চালিয়ে যান স্বল্পমূল্যে ট্যাবলেট কম্পিউটারের খোঁজে। অবশেষে সব ব্যবস্থা হয়ে গেলে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর আরবান অ্যাকাডেমির প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া ৪০ শিক্ষার্থীর হাতে কি-বোর্ডযুক্ত ট্যাবলেট কম্পিউটার তুলে দেওয়া হয়। ‘স্বদেশ’ নামের এই ট্যাবলেট কম্পিউটার বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে শিশুদের পাঠদানের উপযোগী করে। প্রতিটি ট্যাবলেটে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রথম শ্রেণির সিলেবাস অনুসরণ করে তৈরি করা বিজয় প্রাথমিক শিক্ষা-১ সফটওয়্যার ইনস্টল করা আছে৷ উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে চলা এসব কম্পিউটার ও ডিজিটাল শ্রেণিকক্ষের কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে বিজয় ডিজিটাল৷ সৈয়দ আরিফুজ্জামান ২০১৮ সালের মধ্যে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর হাতে এই ট্যাবলেট কম্পিউটার পৌঁছে দেওয়ার আশা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘খুব দ্রুত এই শিক্ষার্থীরা ট্যাবলেট কম্পিউটারের ব্যবহার আয়ত্ত করে ফেলেছে। শিখছেও দ্রুত। এই মাধ্যমে শিক্ষা খুব কার্যকর হচ্ছে।’
আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রে যে বিপ্লবের সূচনা হয়েছে, আমাদের দেশে তা হচ্ছে এত দিন পর। তবু তো চাকা গড়াল! সে জন্যও উদ্যোক্তারা একটা ধন্যবাদ তো পেতেই পারেন। তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে একদিন জ্যোতির্ময় বাংলাদেশ গড়ে উঠবে এমনটাই সবার প্রত্যাশা।