শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে বহু শিশু

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তাঁতের কাপড় তৈরির কারখানায় কর্মরত এক শিশুশ্রমিক ।  ছবি: হাসান রাজা
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তাঁতের কাপড় তৈরির কারখানায় কর্মরত এক শিশুশ্রমিক । ছবি: হাসান রাজা

মাথার ওপর প্রচণ্ড রোদ। এ রোদ মাথায় নিয়ে ইট ভাঙছিল মো. নাজমুল (১০)। শরীর থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছিল ঘাম। ১৯ মার্চ দুপুরে নাজমুলের দেখা পাই রাজধানীর হাতিরপুলে একটি নির্মাণাধীন বাড়ির সামনে। নাজমুল জানায়, সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সারা দিন ইটের খোয়া ভাঙলে ১০০ টাকা পাওয়া যায়। সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তার মা একটি বাটিতে খাবার দিয়ে দেয়। সেই খাবার সে দুপুরে খায়। নাজমুলের বাবা আরেকটি বিয়ে করেছেন বলে তাদের আর খোঁজখবর নেন না তিনি। নাজমুলের মা বিভিন্ন বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ থাকলেও অভাবের কারণে নাজমুলের আর বিদ্যালয়ে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
‘সকাল নয়টার সুময় আসি। হারা দিন কাম করি। দোকানে মাল উঠাই, কাস্টমারগো মাল রিকশা, গাড়ি পর্যন্ত আউগায় দিয়া আসি’। কথাগুলো বলছিল ১২ বছরের শিশু ফজল মিয়া। শান্তিনগর বাজারের একটি দোকানে কাজ করে সে। সকাল নয়টায় আসে। বাসায় ফেরে রাত নয়টায়। মাস শেষে বেতন পায় দেড় হাজার টাকা।
জীবিকার তাগিদে নাজমুল ও ফজল মিয়ার মতো অসংখ্য শিশু আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিয়োজিত। যে বয়সে তাদের বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা টাকা রোজগারের জন্য কাজ করছে।
বাংলাদেশের শ্রম আইন (২০০৬) অনুসারে শ্রমিকের বয়স ১৪ বছরের নিচে হওয়া যাবে না। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। শ্রমে নিয়োজিত বহু শিশুরই বয়স ১৪ বছরের নিচে।
শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলো বলেছে, দেশে ৭৪ লাখের বেশি শিশু বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিয়োজিত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিশুরা ব্যাটারি নির্মাণ কারখানা, প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরির কারখানা, চামড়ার কারখানা, মোটরগাড়ি ও রিকশা সারাইয়ের গ্যারেজ, সাইকেল নির্মাণ কারখানা, ইটভাটা, চায়ের দোকানসহ বিভিন্ন দোকান, হোটেল, রেস্তোরাঁ, পোশাক কারখানা, জাহাজশিল্প, চিংড়ির হ্যাচারি,বেলুন কারখানা,জুটমিল ও বাসাবাড়িতে কাজ করে জীবন-জীবিকার পথ খোঁজে। অনেক শিশু রাজমিস্ত্রির সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া অনেক শিশু বাস, টেম্পো, হিউম্যান হলার এসব যানবাহনে সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিশুদের অল্প পারিশ্রমিক দিয়ে বেশি কাজ করে নেওয়া যায় বলে মালিকেরাও তাদের নিয়োগ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাটারি নির্মাণ কারখানার মালিক বলেন, ‘শিশু শ্রমিকেরাই ভালো। যা মজুরি দেই বাড়াবাড়ি করে না। কামও ভালো করে। আর ওগোও তো টেকা দরকার। দুই পক্ষেরই লাভ। লোকসান নাই।’
কয়েকজন শিশুশ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অনেকেই অল্প বয়স থেকে কাজ করছে। কেউ দুই-তিন বছর বিদ্যালয়ে গেলেও অভাবের তাড়নায় তাদের বাবা-মা কাজে পাঠাতে বাধ্য করছেন।
সরকারি হিসাবে সারা দেশের ৯৯ শতাংশের বেশি শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঝরে পড়া শিশুদের একটি বড় অংশ বিভিন্ন শ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরো সর্বশেষ ২০১০ সালে শ্রম জরিপ করে। এরপর সম্প্রতি তারা আবারও এই জরিপের উদ্যোগ নিয়েছে। জরিপের সঙ্গে জড়িত একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মাঠপর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ শেষ হয়েছে। ওই জরিপে শিশুশ্রমের ওপর আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জরিপের বিষয়ে আগাম কোনো তথ্য প্রকাশ না করলেও তিনি জানান, দিন দিন বিভিন্ন কাজে শিশুদের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। জরিপের ফলাফলে এই অবস্থার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০১১ সালের জাতীয় শিশুনীতিতে ঝুঁকিপূর্ণ ও নিকৃষ্ট ধরনের শ্রমসহ বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের প্রত্যাহারের কথা বলেছে। এ ছাড়া তাদের দারিদ্র্যের চক্র থেকে বের করে আনার লক্ষ্যে পিতা-মাতাদের আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা, বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার জন্য বৃত্তি ও আনুতোষিক প্রদান করার কথা বলেছে।
ওই শিশুনীতি অনুসারে শিশুশ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে পিতা-মাতা, সাধারণ জনগণ ও সুশীল সমাজের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, ২০১৫ সালের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শিশুশ্রম নির্মূলের লক্ষ্যে বিভিন্ন স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কৌশল ও কর্মসূচি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এর বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।
বিভিন্ন কাজে শিশুদের ব্যবহারের বিষয়ে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, আইনে শিশুশ্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। শিশুশ্রম বন্ধ করতে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ হওয়া দরকার। আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে কি না, এটি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এ জন্য আরও আরও বাজেট ও জনবল বাড়াতে হবে।
শ্রমবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শ্রম আইন আমাদের দেশে পুরোপুরি মানা হয় না।’ তিনি জানান, গত বছর শ্রম মন্ত্রণালয় ৪৬ ধরনের কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যার অনেক কাজই শিশুরা করছে। অথচ আইন অনুসারে ১৪ বছরের নীচে বয়স এমন শিশুরা কোনো ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারবে না। এ ছাড়া তাদের পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু এগুলো মানা হয় না। মালিক ও শ্রমসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোও এ বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক নয়। শিশুশ্রম বন্ধে সরকারের কড়া নজরদারির পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার প্রতি জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।