সন্তানকে অনলাইন হয়রানি থেকে রক্ষায় অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে

গত বছরের মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্বে করোনাভাইরাসের বিস্তার শুরু হয়। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সরকারের সিদ্ধান্তে বিভিন্ন বয়সী শিশু শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করছে। প্রযুক্তিগত সুবিধার কারণে শিশুরা ঘরে বসে যেমন পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে, তেমনি অভিভাবকদের অসচেতনতার কারণে বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটছে। প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলেই এর সুফল ভোগ করা যায়। তাই সচেতন হতে হবে অভিভাবকদের।

ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার  বলছেন, বর্তমান ডিজিটাল যুগে মুঠোফোনসহ বিভিন্ন ডিভাইস থেকে শিশুদের দূরে রাখার উপায় নেই। দূরে রাখলে বরং শিশুদের জন্যই ক্ষতি হবে। ইন্টারনেট নিরাপদ করার দায়িত্ব সরকারের। আইনগত সংস্কার ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে সরকার চেষ্টা করছে। শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহারে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অভিভাবকদের অসচেতনতা।

এডিসি নাজমুল ইসলাম বললেন, সাইবার অপরাধ থেকে শিশুদের নিরাপদ রাখতে বা শিশুদের নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারে সরকারের পাশাপাশি অভিভাবকদের বিশাল ভূমিকা আছে। অভিভাবকেরাই বুঝতে পারবেন তাঁর সন্তান কোন সাইটে ঢুকছে। সন্তান যে মুঠোফোন বা ডিভাইস ব্যবহার করবে, তাতে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল থাকা জরুরি, এতে অনেক কনটেন্টের নাগাল শিশু পাবে না। সরকারও বিভিন্ন কনটেন্ট বা সাইট ফিল্টারিং করছে। সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে কর্মরতদের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে সরকার।

করণীয়:

আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড প্রোটেকশন, চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স সেক্টরের পরিচালক আব্দুল্লা আল মামুন বললেন, শিশুদের অনলাইনে পড়াশোনা আর অনলাইনে আসক্তি এক বিষয় নয়। অনলাইনের অতিরিক্ত ব্যবহারে শিশুর খেলাধুলা, খাওয়া এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কি না, সুযোগ পেলেই অনলাইনে সময় কাটাচ্ছে কি না, তা অভিভাবকদের দেখতে হবে। অনলাইন আসক্তি মানসিক ব্যাধি। আসক্তির ফলে শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সমাধানে অভিভাবকদের শিশুদের এই ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সন্তান কতক্ষণ অনলাইনে, কোন সাইটে থাকবে, তার নজরদারি থাকতে হবে। শিশুদের গুণগত সময় দিতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের শিক্ষাক্রম ও গবেষণা, প্রশিক্ষণ বিভাগের সহকারী পরিচালক রোখসানা পারভীন বললেন, করোনা যেহেতু দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা, তাই অভিভাবকেরা চাইলেও শিশুদের হাত থেকে ডিভাইস সরিয়ে ফেলতে পারবেন না। তাই অনলাইনের পাশাপাশি অফলাইনে শিশুদের পড়াশোনা, ছবি আঁকা, শারীরিক ব্যায়ামসহ বিভিন্ন বিষয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে। সরকারকেও শিশুদের অনলাইন ব্যবহারে নীতিমালা প্রণয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে কোনো শিশুই অনলাইনের মাধ্যমে ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে।

ডিজিটাল পরিবেশে শিশুদের জন্য নিরাপদ অনলাইন অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করতে গ্রামীণফোনের ফ্ল্যাগশিপ উদ্যোগ ‘চাইল্ড অনলাইন সেফটি প্রোগ্রাম’। ২০১৪ সাল থেকে গ্রামীণফোন শিক্ষক, শিশু এবং অভিভাবকদের নিরাপদ ইন্টারনেট পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে নানা কর্মসূচি পালন করছে। ২০১৮ সাল থেকে ইউনিসেফের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে নিরাপদ ইন্টারনেট বিষয়ে কাজ শুরু করেছে।

গ্রামীণফোনের বহির্যোগাযোগ–প্রধান (এক্সটার্নাল কমিউনিকেশন) মোহাম্মদ হাসান সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক বছরে ইউনিসেফের সঙ্গে মিলে গ্রামীণফোন ১০ লাখ শিশু এবং ২ লাখ ৭০ হাজার অভিভাবক, শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে গ্রামীণ, নিম্নবিত্ত সম্প্রদায়সহ গ্রামীণফোন ছয় লাখ শিশুকে প্রশিক্ষণ দেবে।

মোহাম্মদ হাসান বললেন, করোনায় শিশুদের মুঠোফোন ব্যবহার অনেক বেড়েছে। এই সময়ে শিশুদের ঝুঁকি কমাতে এবং অভিভাবকদের করণীয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্রামীণফোন ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ডিভিশনের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. নাজমুল ইসলাম কিছুটা আশার কথা শোনালেন। জানালেন, অনলাইনে হয়রানি নিয়ে অভিযোগ পেলে তার ৮০ শতাংশ অভিযোগকারীকেই সন্তুষ্ট করা সম্ভব হচ্ছে। তবে এ সন্তুষ্টির মাত্রা শতভাগ করতে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

৯ ফেব্রুয়ারি নিরাপদ ইন্টারনেট দিবস। এই দিবসের অঙ্গীকার হোক শিশুদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেটের সুবিধা। শিশুদের জন্য অনলাইনের নিরাপত্তাবিষয়ক সচেতনতার জন্য জাতীয় পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রমে আলাদা অধ্যায় ও গ্রন্থ যুক্ত হওয়া দরকার।

তা ছাড়া, শিশু ও অভিভাবকদের ঠিক লাইনে অনলাইনে রাখতে, অর্থাৎ সঠিক নিয়মে নিরাপদে ইন্টারনেট ব্যবহার শেখানোর উদ্দেশ্যে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণফোন, টেলিনর গ্রুপ ও ইউনিসেফ। চাইল্ড অনলাইন সেফটি কার্যক্রমের আওতায় (https://www.telenor.com/digiworld-en/) খেলার মাধ্যমে শেখা যাবে কী করে অনলাইনে নিরাপদে থাকা যায়। বিভিন্ন বয়সক্রম অনুযায়ী খেলাটি সফলভাবে শেষ করলে অংশগ্রহণকারী পাবে একটি অনলাইন সেফটি সার্টিফিকেট।