সাতটি সৃজনশীল মাত্র!

রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। এলাকার ছোট ভাই রাফসানের সঙ্গে দেখা। ছেলেটা এতই শুকনা যে সবাই ‘শুঁটকি রাফসান’ বলে ডাকে। আমি ওকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিরে শুঁটকি, কী অবস্থা?’
: এই তো ভাই, আছি ভালোই।
: যাস কই?
: জিমে যাচ্ছি, ভাই।
: তুই যাবি জিমে? জিমে? তোর শরীরে কিছু আছে রে? জিমে গিয়ে তুই করবিটা কী?
: ভাই, গায়ে কিছু থাকুক আর না থাকুক, জিমে যেতেই হবে। শক্তি দরকার।
: এত শক্তি দিয়ে কী করবি? পাড়ার মাঠে তো কোনো দিন খেলাধুলা করতে দেখলাম না। আর তোর না সামনে এইচএসসি পরীক্ষা? যা, পড়ালেখা কর।
আমার কথা শুনে কটমটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে গেল। আমি কিছু না বুঝে হাঁটতে লাগলাম। কিছুদূর যেতেই দেখি পাড়ার আরেক ছোট ভাই গাবলু হাফপ্যান্ট পরে রাস্তায় ম্যারাথন দিচ্ছে। গাবলুটার নাম যেমন গাবলু, দেখতেও গাবলু। ডাক দিলাম ওকেও, ‘কিরে গাবলু, দৌড়াস কেন?’
: স্ট্যামিনা বাড়াতে হবে, ভাইয়া।
: কেন, অলিম্পিকে যাবি নাকি? তোর জন্য তো এক ট্র্যাকে জায়গা হবে না রে।
: সব সময় ফাজলামো করেন কেন! ভাল্লাগে না। সামনে আমার এসএসসি না?
: হ্যাঁ, তোর এসএসসি তো সামনেই। এখন তুই নিউ টেনে না?
: হ্যাঁ, এ জন্যই তো দৌড়াচ্ছি।
: সামনে এসএসসি পরীক্ষা, তো সে জন্য দৌড়াতে হবে কেন? তোদের সবার হলোটা কী? আর পরীক্ষার জন্য এত স্ট্যামিনারই বা কী দরকার? যা, বাসায় গিয়ে পড়ালেখা কর।
গাবলু আমার দিকে একটা ভয়ানক গাবলু লুক দিল! আমি আর ওকে না ঘাঁটিয়ে আবার হাঁটা ধরলাম।
চারমাথায় যেতে না–যেতেই দেখা হলো বন্ধু ‘ব্যবসা বাবলুর’ সঙ্গে। বাবলুর বৈশিষ্ট্য হলো, সে কদিন পরপর নতুন নতুন ব্যবসা করে; আর সবগুলোয় মার খায়। ওকে দেখলেই আমি উল্টোদিকে পালাই। না হয় তার নতুন ব্যবসার পরিকল্পনা সে আমাকে মুখস্থ করিয়ে ছাড়ে এবং আমাকে তার ব্যবসায়িক পার্টনার হওয়ার প্রস্তাব দেয়। এবং আমি যে তার ব্যবসায়িক পার্টনার হতে চাই না, সেটা বোঝাতেও কমসে কম তিন-চার ঘণ্টা লেগে যায়। তাই আমি পেছন ঘুরে জোর কদমে হাঁটতে শুরু করলাম। কোনো লাভ হলো না। বাবলু পেছন থেকে আমার ঘাড় ধরে বলল, ‘আরে বন্ধু, কী অবস্থা? কই যাও? আচ্ছা, যেইখানে যাইবা যাইয়ো, নতুন একটা ব্যবসা খুলতাছি, পার্টনার হইবা?’
: না রে, বাবলু...
: আরে ‘না’ পরে কইয়ো, আগে শোনো। একটা কোচিং সেন্টার দিব।
চমকে উঠলাম। যে বাবলু জীবনে কোনো দিন ঠিকমতো পড়ালেখা করল না, সে আবার কিসের কোচিং সেন্টার দেবে? আমার অবাক দৃষ্টি দেখে বাবলু বলল, ‘এমনে তাকাও কেন, মিয়া? আমি হাতের লেখার কোচিং সেন্টার দিব। কেমনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খালি লেইখাই যাওয়া যায়, লেইখাই যাওয়া যায়, সেইটার কোচিং হবে।’
: এত ঘণ্টার পর ঘণ্টা লিখে হবেটা কী? কবি-সাহিত্যিকদের জন্য নাকি? তারাও তো এত লেখেন না মনে হয়।
এই প্রথম মনে হয় বাবলু আমার ওপর নাখোশ হলো। বলল, ‘তোমারে দিয়া ব্যবসা হইব না, মিয়া! কবি-সাহিত্যিকদের লাইগা হইব কেন? এসএসসি আর এইচএসসি পরীক্ষার্থী গো লাইগা। লগে ডাক্তারও থাকব। লিখতে লিখতে কারও হাত খুইলা পইড়া গেলে জোড়া লাগায়া দিবো সেই ডাক্তার। দুনিয়াদারির খবর তো মনে হয় কিছুই রাখো না!’ এই বলে সে চলে গেল হনহন করে। আমি একপ্রকার খুশিই হলাম। যাক, বাঁচা গেল!
এরপর আর কারও সঙ্গে দেখা হলো না কপালগুণে! বাসায় চলে এলাম কিছুক্ষণ পর। এসেই পত্রিকাটা হাতে নিলাম। আসলেই দিনদুনিয়ার খবরাখবর রাখা হচ্ছে না। দেশের লোকজন কী উদ্ভট সব কাজকর্ম করছে, যার আগামাথা কিছুই বুঝি না। পত্রিকার এক জায়গায় দেখলাম, এখন থেকে এসএসসি আর এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের সাতটা করে সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। মাত্র সাতটা সৃজনশীল? খবরটা দেখে আবেগে চোখে পানি চলে এল। গাবলু আর রাফসানের জন্য মায়াও হলো। আহা, বেচারারা! তারপর আমি আমার আঙুলগুলোর দিকে মায়া মায়া দৃষ্টিতে তাকালাম। ভাগ্য ভালো, এসএসসি আর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছিলাম, না হয় এই আঙুলগুলো এখন যেমন আছে তেমন থাকত বলে মনে হয় না! অন্যদিকে বাবলুর জন্য অবশ্য মনটা খুশি হয়ে উঠল, এবার বোধ হয় প্রথমবারের মতো ব্যবসায় সফল হতে যাচ্ছে সে!