সৃজনশীলতার তিন দশক

ম্যাকিন্টোশের সঙ্গে স্টিভ জবস
ম্যাকিন্টোশের সঙ্গে স্টিভ জবস

অনেকেরই মনে থাকার কথা নয় যে এখন থেকে ৩০ বছর আগে মাত্র নয় ইঞ্চি সাদা-কালো পর্দার অল-ইন-ওয়ান একটি পারসোনাল কম্পিউটারে মাউস যুক্ত হলো আর তার সঙ্গে এল ম্যাকিন্টোশ অপারেটিং সিস্টেম এবং ম্যাকরাইট, ম্যাক পেইন্ট ও ম্যাক ড্র সফটওয়্যার। সারা দুনিয়াতে তখন আইবিএম ঘরানার পারসোনাল কম্পিউটারের অপ্রতিরোধ্য জয়জয়কার। এসএম ডস, ওয়ার্ডস্টার লোটাস ১-২-৩ ও ডিবেসের সেই জামানায় সিনটেক্স লিখে বা প্রোগ্রামিং জেনে যখন কম্পিউটার ব্যবহার করতে হয়, তখন স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা কোনো কমান্ড মুখস্থ না করেই পিসি ব্যবহার করা শুরু করল। এই কম্পিউটার আবার সাইকেলের পেছনে বসিয়ে যেখানে-সেখানে নিয়েও যাওয়া যায়৷ গোটা দুনিয়ার সাধারণ মানুষ প্রথম অনুধাবন করল, কম্পিউটার মানে কমান্ড মুখস্থ রাখা, বাইনারি অঙ্ক জানা বা প্রোগ্রামিং করা নয়। বিশ্ববাসী সবচেয়ে বেশি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেছিল, কম্পিউটারের ভাষা ইংরেজি থেকে যেকোনো ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে গেল। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে গেল, কম্পিউটার দিয়ে কেবল লেখালেখি, হিসাব-নিকাশ বা তথ্যবিন্যাস করা নয়, এটি দিয়ে ছবি অঁাকা যায়, শব্দ ব্যবহার করা যায়, হয়ে ওঠা যায় সৃজনশীল মানুষ।
১৯৭৯ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের প্রধান পুরুষ ছিলেন জেফ রাসকিন। ম্যাক কম্পিউটারটির পূর্বসূির হিসেবে অ্যাপল কম্পিউটার ১৯৮৩ সালে লিজা নামের আরও একটি কম্পিউটার বাজারে এনেছিল। তবে সেটি উচ্চমূল্যের জন্য সফল হতে পারেনি। কিন্তু ম্যাকিন্টোশে সাড়ে তিন ইঞ্চি ফ্লপি ডিস্ক ও গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস ধারণাটি লিজা থেকেই গ্রহণ করা হয়।
১৯৮৪ সালে জন্ম নেওয়ার পর ১৯৮৭ সালে ম্যাকিন্টোশ কম্পিউটারে রঙিন মনিটর আসে। কালক্রমে এতে যুক্ত হয় মেটারোলা রিস্ক প্রসেসর এবং সর্বশেষ এর গতি সঞ্চার করছে ইন্টেলের অতি জনপ্রিয় প্রসেসর। সারা পৃথিবীতে ম্যাকিন্টোশ সব রকমের সৃজনশীল কাজের শ্রেষ্ঠতম যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রকাশনা, গ্রাফিকস, অডিও-ভিডিও, অ্যানিমেশনসহ সব ধরনের সৃজনশীল কাজের জন্য এই কম্পিউটারকে এখনো বিশ্বসেরা বলে মনে করা হয়। মূলত এরই প্রযুক্তি দিয়ে গড়ে উঠেছে উইন্ডোজ নামের জনপ্রিয়তম অপারেটিং সিস্টেম। ম্যাকের প্রযুক্তিগুলো আজ দুনিয়ার সব পারসোনাল কম্পিউটারের মূল সঙ্গী হয়ে পড়েছে।
১৯৮৪ সালের ২৪ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া ম্যাকিন্টোশ সেই সময়ে কেবল একটি নতুন উদ্ভাবন, একটি নতুন পণ্য বা নতুন ধারণা ছিল না, ছিল একটি বিপ্লবের নাম। মাত্র ১২৮ কিলোবাইট স্মৃতিসংবলিত মেটারোলা ৬৮০০০ প্রসেসরে তৈরি সেই কম্পিউটার বাংলাদেশের জন্যও এক বিপ্লবের নাম। একে ভিত্তি করে জন্ম নেয় শহীদলিপি সফটওয়্যার। বাংলাদেশি প্রকৌশলী সাইফুদ্দাহার শহীদ লন্ডনে বসে প্রথম ম্যাকিন্টোশ কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম ও ম্যাকরাইট প্রোগ্রামের বাংলা অনুবাদ করেন এবং প্রথম বিটম্যাপড বাংলা ফন্ট উদ্ভাবন করেন। বাংলাদেশে শহীদলিপি নামে পরিচিত এই সফটওয়্যার প্রথম জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটে ব্যবহৃত হয় এবং কম্পিউটারে বাংলা লেখার একটি নতুন যুগের সূচনা হয়।
১৯৮৭ সালের ১৬ মে ম্যাকিন্টোশ কম্পিউটার দিয়েই কম্পিউটারে কম্পোজ করা প্রথম বাংলা পত্রিকা আনন্দপত্র প্রকাশিত হয়। পেশায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সৈয়দ মাইনুল হাসান ম্যাকিন্টোশ কম্পিউটারে মাইনুললিপি নামে যে ফন্ট ও জব্বার কি-বোর্ড নামে যে কি-বোর্ড প্রচলন করেন, পত্রিকাটি সেই প্রযুক্তি দিয়েই প্রকাশিত হয়। এরপর বাংলাদেশ প্লাবিত হয় ডেস্কটপ প্রকাশনা (ডিটিপি) বিপ্লবের জোয়ারে। বাংলাদেশে ম্যাকিন্টোশ কম্পিউটারের সর্বাধিক প্রচলিত প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয় ১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সেদিন বিজয় নামের কম্পিউটারে বাংলা লেখার িক-বোর্ড ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনার জগৎ পায় বিশ্বের আধুনিকতম কম্পিউটার প্রযুক্তি। ১৯৯৩ সালে আইবিএম পিসিতে উইন্ডোজ ৩.০ অপারেটিং সিস্টেম চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত ম্যাকিন্টোশই ছিল কম্পিউটার দিয়ে মুদ্রণমানের বাংলা লেখালেখির একমাত্র বাহন।
২০১৪ সালে ম্যাকিন্টোশ প্রযুক্তির ৩০তম বার্ষিকীতে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিকাশে এর অবদান এবং সাধারণ মানুষের হাতে কম্পিউটারে প্রযুক্তি পেঁৗছে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়র কথা স্মরণ করি। এটি নিশ্চিত করেই বলা যায় যে ম্যাকিন্টোশ কম্পিউটারের জন্ম না হলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কম্পিউটারের সখ্য হয়তো আরও অনেক দেরিতে হতো।
লেখক: বিজয় কি-বোর্ড ও সফটওয়্যারের নির্মাতা