২০১৪ সালের এসএসসি পরীক্ষা: বিশেষ প্রস্তুতি-১১

মাসুক হেলাল
মাসুক হেলাল

সৃজনশীল প্রশ্ন  অংশ-১
প্রিয় এসএসসি পরীক্ষার্থী, শুভেচ্ছা রইলো। আজ বাংলা ১ম পত্রের ‘ছুটি’ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করব।
ছুটি
মূলভাব: এই গল্পের মূলভাব হলো, বয়ঃসন্ধিকাল বা ১৩-১৪ বছর বয়সের সংবেদনশীলতা/স্পর্শকাতরতা। এই দিকটি প্রকাশের পাশাপাশি লেখক ফটিক চরিত্রের বেশ কিছু দিক সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।
বয়ঃসন্ধিকালের সংবেদনশীলতা: শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে বয়ঃসন্ধিকাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩-১৪ বছরের ছেলেমেয়েদের ‘বালাই’ বলেছেন। অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালকে লেখক আপদ-বিপদ বা অকল্যাণকর বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ, এ সময়টাতে হঠাৎ করে অধিক শারীরিক বৃদ্ধি ঘটে, যেটাকে অনেকেই কুশ্রী স্পর্ধা রূপে দেখে। তাছাড়া শৈশবের লালিত্য ও মিষ্টতা চলে যায় বলে এ বয়সটা অন্যের মনে স্নেহের উদ্রেক করে না। আর এদের কথামাত্রই প্রগলভতা অর্থাৎ অসংকোচে, নির্লজ্জভাবে, স্পষ্ট ভাষায় এরা কথা বলে। তাই এসব কারণে বয়ঃসন্ধিকাল অত্যন্ত স্পর্শকাতর বা সংবেদনশীল। আর এ সময় ছেলেমেয়েরা সবার কাছেই বেশি স্নেহ-ভালোবাসা চায়। কিন্তু অনেকেই এদের স্নেহ করতে সাহস দেখায় না, বরং নিষ্ঠুর, রুক্ষ, রূঢ় আচরণ করে। স্নেহ-বঞ্চিত হয়ে অযত্ন, অবহেলায় এরা সে সময় নিজেকে কোথাও খাপ খাওয়াতে পারে না। নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয়ে থাকে। এভাবে আস্তে আস্তে মানসিক চাপ বাড়তে থাকে এবং একসময় দেখা দেয় ফটিকের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো এক দুর্ঘটনা।
ফটিকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য: ফটিক ছিল গ্রামের দুরন্ত, ডানপিটে এক কিশোর। খোলা মাঠে বোঁ বোঁ শব্দে ঢাউস ঘুড়ি উড়ানো, অকর্মণ্যভাবে ‘তাইরে নাইরে নাইরে না’ করে ঘুরে বেড়ানো, দিনের মধ্যে যখন-তখন নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোসল করা, দলবল, উপদ্রব, স্বাধীনতা—এ সব কিছুই ছিল তার মধ্যে। প্রত্যুৎপন্নমতিতা ও নেতৃত্বের গুণাবলির কারণে সে ছিল বালকদের সরদার। সত্যবাদিতার কারণে মায়ের সামনেই ছোট ভাই মাখনকে মারতে দ্বিধা করেনি সে। নতুন কিছুর প্রতি দুর্বার কৌতূহলের কারণে সে কলকাতায় আসার জন্য মরিয়া ছিল। আর সে জন্য তার অত্যন্ত প্রিয় ছিপ, ঘুড়ি, লাটাই স্বত্ব ত্যাগ করে মাখনকে পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে ভোগদখলের অধিকার দিতে দ্বিধা করেনি সে। তাছাড়া মাতৃভক্তি, ভ্রাতৃপ্রেম, বন্ধুবাৎসল্য তো ছিলই। ফটিক চরিত্রের আকর্ষণীয় দিকটি হলো, তার আত্মসম্মানবোধ। কলকাতায় এসেই যখন সে বুঝল মামির স্নেহহীন চোখে সে দুর্গ্রহের (যাকে বহু কষ্টে গ্রহণ করা হয়) মতো, তখন থেকেই মামি কোনো কাজ করতে বললে সে তার চেয়ে বেশি করত। কিন্তু মামি তাতেও সন্তুষ্ট হতো না বরং ফটিকের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করত। বই হারানোর পর মামির কাছে বই কিনতে চাইলে মামির কটাক্ষে সে বুঝতে পারে, সে পরের পয়সা নষ্ট করছে। আর তখনই সে নিজের হীনতা ও দীনতার কারণে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। ফটিক জ্বরে আক্রান্ত হলে মামিকে বাড়তি কোনো জ্বালাতন করতে চায়নি। তাই তো সে পালিয়ে মায়ের কাছে গ্রামে রওনা দেয়।
ফটিকের করুণ পরিণতির কারণ: গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা ফটিক পড়াশোনার জন্য শহরে এসে করুণ পরিণতি লাভ করে অজানার দেশে পাড়ি জমায়। বেশ কিছু ঘটনা ও প্রসঙ্গ ফটিকের এ করুণ পরিণতির সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে অন্যতম হলো মামির স্নেহহীনতা। নিজের তিন ছেলে ও স্বামী-সংসারের মধ্যে ফটিকের আগমন ভালোভাবে গ্রহণ করেনি মামি। স্নেহকাতর ফটিক সামান্য স্নেহের জন্য মামির প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কাজ করত। কিন্তু মামি তাতেও সন্তুষ্ট হতো না, বরং ফটিকের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করত। মামির এ গুণটির যথার্থ উত্তরাধিকারী ছিল তার তিন ছেলে অর্থাৎ ফটিকের মামাতো ভাইয়েরা। স্কুলে ফটিকের সঙ্গে তারা সম্পর্ক স্বীকার করতে লজ্জাবোধ করত এবং ফটিকের অপমানে অন্যদের চেয়ে বেশি আনন্দিত হতো। এদিকে মামির স্নেহহীনতা ও মামাতো ভাইদের অসৌজন্যমূলক আচরণে ফটিক মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে থাকে। তাই সে পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়, বই হারিয়ে ফেলে। শিক্ষক এ ক্ষেত্রে ফটিকের মানসিক অবস্থা বুঝতে পারলে হয়তো পরিণতি অন্যরকম হতো।
অন্য যে বিষয়টি ফটিকের করুণ পরিণতির জন্য বেশি দায়ী তা হলো, শহরের ইট-কাঠ-পাথরের বদ্ধ পরিবেশ। গৃহের আরোপিত পরিবেশ বা শহরের জীবনযাত্রা মোটেও ফটিকের জন্য অনুকূল ছিল না। অবারিত মাঠঘাট, নদীনালা আর মাটির সোঁদা গন্ধে বেড়ে ওঠা ফটিকের জন্য মামির বাসা ছিল নরকতুল্য। চার দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়ে কেবলই তার গ্রামের কথা মনে পড়ত। স্কুলেও একই অবস্থা । মোট কথা, স্নেহহীন প্রতিকূল পরিবেশে পড়ে ক্রমাগত ফটিকের মানসিক চাপ বাড়তে থাকে। একদিন প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মায়ের কাছে গ্রামে রওনা দেয়। বৃষ্টিতে ভিজে অসুস্থ হয়ে পুলিশের সহায়তায় মামার বাড়িতেই আবার ফিরে আসে। জ্বরের ঘোরের মধ্যে সে খালাসিদের মতো ‘এক বাঁও মেলে না, দো বাঁও মেলে না’ করে জীবনের তল খুঁজতে চায়। কিন্তু অতল জীবনের গহিন অন্ধকারে সে চিরদিনের মতো ছুটি নিয়ে হারিয়ে যায়।

সিনিয়র শিক্ষক, সেন্ট গ্রেগরী হাইস্কুল, ঢাকা

পরবর্তী অংশ ছাপা হবে আগামীকাল