
‘ওয়াও! চেলসি গতকাল দারুণ খেলেছে!’ ‘কারও কাছে কি ম্যানেজমেন্ট বইটা আছে? থাকলে জানাও।’ ‘লম্বা একটা ঘুম দিয়ে উঠলাম। আজ ছুটি। সারা দিন সিনেমা দেখব।’
এমনই সাদামাটা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শোভনের (ছদ্মনাম) ফেসবুক স্ট্যাটাসগুলো। হঠাৎই কী যেন কী হলো! ডেথ মেটালের পাঁড় ভক্ত ছেলেটা ফেসবুকের ‘হোয়াটস অন ইওর মাইন্ড?’ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে লিখে ফেললেন, ‘তোমরা যে বল দিবস রজনী ভালোবাসা ভালোবাসা। সখী ভালোবাসা কারে কয়?’ ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুদের মন্তব্যের হিড়িক! ‘ঘটনা কী রে, মামা!’ ‘কিসের যেন গন্ধ পাই!’ চলে একের পর এক বিস্ময়বোধক চিহ্নযুক্ত মন্তব্য। ‘দুষ্টু’ বন্ধুরা ‘আবেগে কাইন্দালছি’ ধরনের কমেন্ট করতেও পিছ-পা হয় না! ওদিকে শোভনের হাল কে বুঝবে? বন্ধুদের বলবেন কী, বেচারা নিজেই বুঝে উঠতে পারেন না, আচানক কোন রোগে পেয়ে বসল তাঁকে! প্রতিদিন ক্লাস, আড্ডা, গান শোনা, টিভি দেখার নিয়মিত রুটিন, সব ঠিক থেকেও কেমন যেন গুবলেট হয়ে যায়! বইয়ের পাতা থেকে শুরু করে মনিটরের পর্দা, সব জায়গায় ঘুরেফিরে ‘তার’ মুখ দেখা যায়!
হুঁ! এতক্ষণে বোঝা গেল রোগের বৃত্তান্ত। শোভনের ভাষায়, ‘ঠিকই ধরেছেন। মনে হচ্ছে ক্রাশ খেয়েছি!’ অভিধান ঘেঁটে পাওয়া গেল, ‘ক্রাশ’ শব্দের অর্থ ভাঙা বা নিংড়ানো। হূদয় ভাঙা বা প্রেমে পড়ার সমার্থক হিসেবে আজকাল তরুণেরা ব্যবহার করছে ক্রাশ শব্দটি। তবে ক্রাশ কীভাবে ‘খায়’, সেটা একটা প্রশ্ন বটে! সেই প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে আমরা বরং তরুণদের কাছে জানতে চাই, প্রেমে পড়ার প্রতিক্রিয়াগুলো। কীভাবে তাঁরা প্রেমের প্রকাশ করেন, প্রেমে পড়লে মনের ‘আবহাওয়া’ই বা কেমন থাকে, জানতে চাই সেসব। মিটিমিটি হেসে তরুণেরা উত্তর দেন, শুনতে মজাই লাগে!
কথা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন তাঁর ‘ক্রাশ-বৃত্তান্ত’! ‘কিছুদিন আগে আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই এক জুনিয়রের প্রেমে পড়েছি। ফেসবুকে বন্ধু হলাম। নিয়মিত কথাও চলছে। ফোনে এসএমএস বিনিময় হয়। আকার-ইঙ্গিতে তাকে আমার মনের কথা বলেছি। সে “হ্যাঁ”ও বলে না, “না”ও বলে না। আমিও জোরাজুরি করি না। কোনো সিদ্ধান্তে আসার আগে যদি দুজনের মধ্যে বোঝাপড়াটা ভালো করে নেওয়া যায়, আমাদের মধ্যে মিলবে কি না, তাতে ক্ষতি কী?’
চারুকলার ছাত্র খোরশেদ আলম অবশ্য এ ধরনের সম্পর্কের নাম দিয়েছেন ‘প্রেন্ধুত্ব’! প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই ব্যাখ্যা করলেন, ‘ক্যাম্পাসে এমন অনেক জুটি দেখি, যারা সারা দিন একসঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। সবাই তাদের “জুটি” হিসেবে চেনে, কিন্তু প্রশ্ন করলে বলে, “না না! আমরা স্রেফ বন্ধু!” এই প্রেমভাবাপন্ন বন্ধুত্বকেই আমরা নাম দিয়েছি প্রেন্ধুত্ব।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সায়িদা সারিয়া আবার ‘সাময়িক ভালো লাগা’-কে গুরুত্ব দিয়ে বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে রাজি নন। বললেন, ‘যাকে ভালোবাসব, তার সঙ্গেই বাকি জীবনটা কাটাতে চাই। মানুষটার মন-মানসিকতা বুঝে, তার পরিবারের সঙ্গে আমার পরিবারের মেলে কি না, সব বিবেচনা করেই এগোতে চাই।’ তবে তরুণেরা এ-ও মানেন, এত অঙ্ক কষে, ব্যাকরণ মেনে প্রেম হয় না। হুট করে হয়ে যায়! আজকাল তাই একদিন ফেসবুকে পরিচয়, দ্বিতীয় দিন ফোনে কথা, তৃতীয় দিন দেখা আর চতুর্থ দিন ‘ভালোবাসি’ বলে ফেলাও চলছে হরদম!
কবি আলফ্রেড খোকন বলেন, ‘ধরুন, ছোটবেলায় আমার একটা সাইকেল কেনার খুব শখ ছিল। বড় হয়ে আমি যদি ৫০০ সাইকেল কিনে ফেলি বা গাড়ি কিনে ফেলি, সেই অতৃপ্তি দূর হবে না। প্রেমটাও এমন। না-পাওয়ার প্রতি একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এখনকার তরুণদের জন্য প্রেম খুব সোজাসাপটা। একসময় চিঠি লেখা হতো, মনের মানুষের সঙ্গে দেখা করতে দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকতে হতো। এখন এসএমএস, ফেসবুক, স্কাইপ আছে! কিন্তু আমার মনে হয়, মনের অনুভূতিটা সেই একই আছে।’