ডাকটিকিটের চাহিদা কি এখনো আছে, ডাকঘরের ভবিষ্যৎই বা কী?

হলোগ্রাফ যুক্ত মার্কিন ডাকটিকিট

সাবিনা ইয়াসমিন গেয়েছিলেন, ‘চিঠি দিয়ো প্রতিদিন, চিঠি দিয়ো/ নইলে থাকতে পারব না।’ সেই চিঠি এখন সময়ের পরিক্রমায় মেসেজ বা ই–মেইলে বিবর্তিত হয়ে গেছে। একসময় তো ডাকটিকিট বা খাম ব্যক্তিগত লেখা থেকে শুরু করে আনুষ্ঠানিক চিঠিপত্র প্রাপকের হাতে পৌঁছে দিত। প্রায় ১৮৪ বছর আগে ১৮৪০ সালে পেনি ব্ল্যাক নামের একটি ডাকটিকিটের প্রথম ব্যবহার শুরু হয়। সাধারণ মানুষের জন্য চালু হওয়ার ১৫০ বছর পর পর্যন্ত দারুণভাবে সারা বিশ্বে ডাকটিকিটের উপস্থিতি দেখা যায়। ১৯৯০ দশকে ই-মেইল নামে প্রযুক্তিগত এক বার্তা প্রেরণের মাধ্যম তৈরি হলে কমতে শুরু করে ডাকটিকিটের আধিপত্য। ডিজিটাল ও অনলাইন যোগাযোগমাধ্যমের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে গেল এক দশকে ডাকটিকিটের ব্যবহার অনেকটাই কমে গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অবশ্য শৌখিন সংগ্রাহকেরা ডাকটিকিট সংগ্রহ করছেন বেশি করে।

গ্রাহক কমছে, দাম বাড়ছে
তারুণ্যের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘রানার’ কবিতায় লিখেছেন, ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে/ রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে, রানার রানার চলেছে, রানার!’ এখন সেই রানার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বিভিন্ন ই–কমার্স সেবা। দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই ই–কমার্সের গাড়ি চলছে পণ্যের বোঝা নিয়ে।

বিশ্বখ্যাত ফোর্বস সাময়িকী জানাচ্ছে, যেখানে বিভিন্ন দেশের ডাক বিভাগের আকার ছোট হচ্ছে, ডাকটিকিটের বিক্রি কমছে, সেখানে ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস পোস্টাল সার্ভিস ডাকটিকিটের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। প্রথম শ্রেণির ডাকটিকিটের মূল্য ৬৬ থেকে ৬৮ সেন্টে বাড়ানো হয়। একটি পোস্টকার্ড পাঠানোর খরচ ৫১ সেন্ট থেকে বাড়িয়ে ৫৩ সেন্ট করা হয়। এরপর ২০২৩ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত চারবার দাম বাড়ানো হয়। বছরে দুবার করে দাম বাড়ানো হবে ২০৩০ সাল পর্যন্ত। পরিচালন ব্যয়ের সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করতেই দাম বাড়াচ্ছে সংস্থাটি।

ব্যবহার কমলেও আছে চাহিদা
ডাকটিকিট বা স্ট্যাম্পের প্রতি তরুণদের আগ্রহের কারণে উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল নকশার চাহিদা বেড়েছে সারা বিশ্বে। জনবহুল দেশগুলোয় ডাকের ব্যবহার কমছে। সেই চ্যালেঞ্জের সঙ্গে মোকাবিলা করতে নানা সেবা চালুর চেষ্টা চলছে। ভারতের ডাক বিভাগ ২০০৬ সালে ব্যক্তিগত ডাকটিকিটের প্রবর্তন করে। যেকোনো ব্যক্তি ও সংস্থা নিজস্ব নকশা, প্রতীক (লোগো) ও ছবির সমন্বয়ে ডাকটিকিট তৈরি করতে পারে। ব্যক্তিগত ডাকটিকিট তৈরির সুযোগে সংগ্রাহকদের জন্য নতুন আগ্রহের পথ তৈরি হয়। টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্যাংকিং ও বিমা কার্যক্রম উন্নত করে ডাকসেবার আধুনিকায়নের চেষ্টা করে ভারতীয় ডাক পরিষেবা বিভাগ। ভারতীয় ডাক পরিষেবা বিভাগ ২০১৩ সালে ই-পোস্ট অফিসের প্রবর্তন করে। ই-পোস্ট অফিস একটি অনলাইন মাধ্যম, যার মাধ্যমে গ্রাহক পণ্যের অবস্থান অনুসরণ করতে পারে। ২০১৮ সালে সংস্থাটি কিউআর কোড সমন্বিত একটি স্মারক ডাকটিকিট চালু করে। অতিরিক্ত তথ্য কিউআর কোড থেকে জানা যায়।

ইউএস পোস্টাল সার্ভিসেসের ডাকটিকিট

ভবিষ্যৎ নিয়ে পরীক্ষা
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ডাকটিকিটে হলোগ্রাফ নিয়ে নানা পরীক্ষা করতে দেখা যায়। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পোস্টাল সার্ভিস বিশ্ব ডাকটিকিট এক্সপোতে প্রথমবারের মতো ইউএস হলোগ্রাফিক স্ট্যাম্প প্রকাশ করে। বৃত্তাকার সেই ইউএস স্ট্যাম্প সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সেই আয়োজনে তিনটি হলোগ্রাফিক স্ট্যাম্প ও প্রথম মার্কিন পঞ্চভুজ ডাকটিকিট চালু করা হয়। ১৯৮৯ সালে মার্কিন ডাক বিভাগ বিশ্বে প্রথম স্ট্যাম্পযুক্ত পোস্টাল খামে হলোগ্রাম যোগ করে।

ডিজিটাল স্ট্যাম্প
কাগজের ডাকটিকিটের চাহিদা সংগ্রহের জন্য বেড়েছে। আবার এই যুগের তরুণেরাও ভিন্ন মাত্রার ডাকটিকিট সংগ্রহ করতে চান। তাঁদের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন সেবা চালু হয়েছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে আয়ারল্যান্ডে বিশ্বের প্রথম ডিজিটাল স্ট্যাম্প চালু হয়। প্রথমবারের মতো আয়ারল্যান্ডবাসীরা ডিজিটাল স্ট্যাম্প কেনার সুযোগ পান।

আয়ারল্যান্ডের যেকোনো জায়গায় চিঠি, কার্ড বা বড় খাম পাঠাতে সেই ডিজিটাল স্ট্যাম্প ব্যবহার করা যায়। আয়ার‍্যলান্ডের রাষ্ট্রীয় ডাক প্রতিষ্ঠান অ্যান পোস্ট এই সেবা চালু করে। ডাকসেবায় ডিজিটাল পণ্য চালুর মাধ্যমে নতুনত্ব দেখা যায় আয়ারল্যান্ডে। অ্যান পোস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গ্যারেট ব্রিজম্যান বলেন, প্রযুক্তিনির্ভর এই ডিজিটাল ডাকটিকিট সবাই ব্যবহার করতে পারেন। যাঁদের হাতে সময় কম কিংবা নিয়মিত পণ্য প্রেরণ করেন, তাঁরা এই ডাকটিকিট ব্যবহার করতে পারেন। অল হিউম্যান নামের একটি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ডিজিটাল স্ট্যাম্প চালু করা হয়। এখন ডিজিটাল স্ট্যাম্পের মাধ্যমে গ্রাহকেরা আয়ারল্যান্ডের যেকোনো স্থান থেকে যেকোনো সময় চিঠি ও পোস্টকার্ড পাঠাতে পারেন। ডিজিটাল স্ট্যাম্প কিনতে মুঠোফোনে একটি পোস্ট অ্যাপ নামাতে হয়।

এস্তোনিয়ায় প্রথম ভবিষ্যতের ডাকঘর
সংগৃহীত

ভবিষ্যতের ডাকঘর
২০০০ থেকে ২০১০ দশকের দিকে সাইবার ক্যাফে সারা দুনিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করেছিল। একসময় মনে করা হচ্ছিল যে ডাকঘর বা পোস্ট অফিস বুঝি উঠেই যাবে। সাইবার ক্যাফে এখন ঘরে ঘরে চলে গেছে, হুমকির মুখেও পড়েছে বিভিন্ন ডাকঘর। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতের ডাকঘর নিয়ে চলছে নানা পরীক্ষা।

ইউরোপের দেশ এস্তোনিয়ার সরকারি ডাকসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এস্তি পোস্ট। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ওমনিভা নামে বিশ্বের প্রথম ‘ভবিষ্যতের ডাকঘর’ চালু করে সংস্থাটি। এস্তোনিয়াজুড়ে আটটি ভবিষ্যতের ডাকঘর চালু করে সংস্থাটি। ভবিষ্যতের ডাকঘরের মাধ্যমে গ্রাহকেরা ই-কমার্স ও ডাক পরিষেবা পাবেন। এসব ডাকঘরে পরিবেশবান্ধব প্যাকেজিং সেবা প্রদান করা হচ্ছে।

ওমনিভার চেয়ারম্যান মার্ট মাগি বলেন, ‘ডাক ও পার্সেল ব্যবসা দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। পণ্য পাঠানোর জন্য শক্তিশালী সেবা চালু হলেও অনেকেই ডাকসেবা ব্যবহার করতে চান। তাঁদের জন্য আমরা আধুনিক ও স্মার্ট পোস্ট অফিস চালু করেছি। ২০২৫ সালের মধ্যে এস্তোনিয়ার সব পোস্ট অফিসকে ভবিষ্যতের পোস্ট অফিসে উন্নীত করা হবে। এসব পোস্ট অফিসে গ্রাহকেরা বই, স্যুভেনির, ঐতিহ্যবাহী ডাকটিকিট ও পোস্টকার্ড কিনতে পারবেন।’ অমনিভার পরিবেশবান্ধব ডাকঘরের নকশা করছেন স্থপতি উর্মাস পাস্তারাস।

ক্রিপ্টো স্ট্যাম্প
গেল কয়েক বছর ধরে সবকিছুতে ক্রিপ্টো আর ব্লকচেইন প্রযুক্তি কড়া নাড়ছে। ডাকটিকিটের দুনিয়ায়ও ক্রিপ্টো করোনা মহামারির সময়ই প্রবেশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন ডাক সংস্থা ক্রিপ্টো স্ট্যাম্প চালু করেছে।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে সুইজারল্যান্ডের সুইস পোস্ট প্রথম ক্রিপ্টো স্ট্যাম্পের ঘোষণা দেয়। পরবর্তী সময়ে জার্মানির ডয়চে পোস্ট দেশের স্থাপনার ছবি দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর ছবিসহ ক্রিপ্টো স্ট্যাম্প চালু করেছে। যেকোনো জার্মান এখন ক্রিপ্টো স্ট্যাম্প অর্ডার করতে পারেন। এসব স্ট্যাম্পে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে জার্মানির বিভিন্ন ঐতিহাসিক ভবনের ছবি যুক্ত আছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে ডয়চে পোস্ট স্ট্যাম্পের প্রথম ঘোষণা দেয়। স্ট্যাম্প আকারে ও ব্লকচেইন-ভিত্তিক ডিজিটাল নন-ফাঞ্জিবল টোকেন বা এনএফটি আকারে এই স্ট্যাম্প পাওয়া যাচ্ছে। ২ লাখ ৫০ হাজার ক্রিপ্টো স্ট্যাম্প ইস্যু করা হয়। ক্রিপ্টো স্ট্যাম্পের ডাকমূল্য ১ দশমিক ৬০ ইউরো। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে জার্মানরা ক্রিপ্টো স্ট্যাম্প কিনতে পারছেন। এনএফটি স্ট্যাম্পের দাম পরে ৯ দশমিক ৯০ ইউরো। এসব স্ট্যাম্পের আনুষ্ঠানিক ইস্যুকারী জার্মানির কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়। পর্তুগাল ও লুক্সেমবার্গও ক্রিপ্টো স্ট্যাম্প চালু করেছে।

সূত্র: স্মিথসোনিয়ান, ফোর্বস, বিবিসি
ছবি: পোস্টাল মিউজিয়াম ও নিউজ ডট ইআরআর ডটইই