খাগড়াছড়ির প্রত্যন্ত গুচ্ছগ্রামে বেড়ে ওঠা আমির এখন তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা

আমির হোসেন
ছবি: প্রথম আলো

খাগড়াছড়ির পাহাড়ের পাদদেশে খাসজমিতে গড়ে ওঠা গুচ্ছগ্রামে কেটেছে আমির হোসেনের শৈশব। অভাব-অনটন আর সামাজিক অস্থিরতা ছিল নিত্যসঙ্গী। তবু স্বপ্ন দেখতেন বড় কিছু করার। ছোটবেলা থেকেই নতুন কিছু, ভিন্ন কিছু করার ভাবনা ঘুরত তাঁর মাথায়। সে কারণেই ঢাকায় ভালো চাকরির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমির নিজের জেলায় চলে আসেন মানুষের জন্য কিছু করার ভাবনা নিয়ে।

খাগড়াছড়ি শহরের প্রাণকেন্দ্র নারকেলবাগানে ছোট ভাই রাসেলকে নিয়ে ২০১৪ সালের গোড়ার দিকেই শুরু হয় আমিরের স্বপ্নের পথচলা। ওই সময় তিনি ভেবে দেখেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও তথ্যপ্রযুক্তি—এ তিন খাতে সারা দেশেই প্রচুর সম্ভাবনা আছে। খাগড়াছড়ির প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে এ তিন খাতের দুর্বলতা একেবারেই স্পষ্ট। আমির সিদ্ধান্ত নেন নিজে কোনো উদ্যোগ নিয়ে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান করার। কিন্তু হাতে তেমন পুঁজি নেই। আর্থিক সচ্ছলতাও ছিল না তাঁর। সংসারের খরচ সামলে নিজের স্বপ্নের পেছনে বিনিয়োগ করতে হবে। সদ্য বিয়ে করায় পরিবার থেকেও গতানুগতিক একটা কিছু করার চাপও ছিল।

সবদিক ভেবে আমির এমন কিছু করার কথা ভাবলেন, যাতে খাগড়াছড়িতে বসে সবকিছু সামলানো যায়। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং গুণগত মানের ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক মেডিসিনের পাইকারি ব্যবসা শুরু করলেন। এর বড় কারণ ছিল আমির নিজে ইউনানি-আয়ুর্বেদিক ওষুধ নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। আমির বিয়ে করেন ২০১৪ সালে। স্ত্রী মর্জিনা আক্তার খাগড়াছড়ির এইচএম পার্বত্য হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা করতেন। পরে আমির নিজেও হোমিওপ্যাথি ও ইউনানি চিকিৎসা বিষয়ে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। এই দম্পতির এখন দুই ছেলে ও এক মেয়ে।

২০১৫ সালে শুরু হয় আমিরের প্রথম উদ্যোগ ‘গুডমর্নিং হোমিওপ্যাথি’। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করে নিজের সুনাম, পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা। এ জন্য ব্যবসার পাশাপাশি তখন থেকেই সাধারণ মানুষদের নিয়ে বিনা মূল্যে বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিষয়ক সেমিনার ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করতেন তিনি। ‘গুডমর্নিং এইড’ নামে একটি ফেসবুক পেজ ও পরবর্তী সময়ে একই নামে স্বাস্থ্যবিষয়ক ই-কমার্স ওয়েবসাইট চালু করেন। এর মাধ্যমে প্রাথমিক চিকিৎসার ‘ফার্স্ট এইড বক্স’ বিক্রি ও প্রাথমিক চিকিৎসার তথ্য আদান-প্রদান করেছেন আমির।

এ উদ্যোগগুলো চালাতে গিয়ে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতা বাড়ানোর গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেন আমির। কারণ, তাঁর উদ্যোগের সঙ্গে ওয়েবসাইট, সফটওয়্যার, ডিজিটাল বিপণন, গ্রাফিক ডিজাইন ইত্যাদি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমির দেখলেন, তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতা থাকলে শুধু ফ্রিল্যান্সিং–আউটসোর্সিং নয়, যেকোনো উদ্যোগে সহজেই সফল হওয়া যাবে।

এডুলাইফের যাত্রা শুরু

২০১৫ সালে ১০ বাই ১৫ ফুটের একটি দোকান ভাড়া নিয়ে নিজের চেম্বার ও ওষুধ ব্যবসা চালাতেন আমির। পাশাপাশি, ভাড়া বাসায় কলেজ ছাত্রছাত্রীদের স্বল্পমূল্যে ইংরেজি পড়ানো শুরু করেন। কয়েকজন শিক্ষার্থীকে কম্পিউটারের প্রাথমিক বিষয়গুলো শেখানোর উদ্দেশ্যে গুডমর্নিং হোমিওপ্যাথি চেম্বারের পাশে আরও একটি ছোট্ট দোকান ভাড়া নেন। আনুষ্ঠানিকভাবে এডুলাইফ ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট চালু করেন। ছোট ভাই রাসেলকে নিয়ে সেই যে যাত্রা শুরু হয়, তা এখনো চলছে।

কেমন ছিল সেই দিনগুলো

আমির বললেন, ‘শুরুটা সহজ ছিল না। কারণ, তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষায় তখনো মানুষের মধ্যে সচেতনতা ছিল না বললেই চলত, অন্যদিকে খাগড়াছড়িতে বিদ্যুতের অবস্থা এতটাই নাজুক ছিল, দিনের বেলায় কম্পিউটার চালু হতো না কম ভোল্টেজের জন্য। এমনকি ফ্যানও চলত না ঠিকমতো। ব্রডব্র্যান্ড ইন্টারনেট তো ছিলই না। গ্রামীণফোন আর টেলিটকের মডেমই ভরসা ছিল। আবার অধিকাংশ মানুষ ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিং বা ওয়েব ডেভেলপমেন্টের মতো বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত ছিল না বললেই চলে। এ জন্য তখন থেকে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে ফ্রিল্যান্সিং ও তথ্যপ্রযুক্তির পেশাবিষয়ক সেমিনার আয়োজন করে আসছি একদম বিনা মূল্যে, যার খরচ আমি নিজে বহন করছি।’

নিজের গড়া এডুলাইফে শিশু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমির
প্রথম আলো

আমির নিজে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট শেখা শুরু করেন ২০১৫ সালে। ঢাকার সফটেক আইটির শিক্ষার্থী এইচ এম মহিউদ্দিনের কাছে হাতে-কলমে আমিরসহ আরও দুজন এটি শেখা শুরু করেন। পাশাপাশি এইচ এম মহিউদ্দিনকে এডুলাইফে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ও এসইও কোর্সের মেন্টর হিসেবে নিয়োগ দেন আমির। বেসিক কম্পিউটার কোর্স সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন তিনি। এভাবে খাগড়াছড়িতে একটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে আমিরের এডুলাইফ।

এডুলাইফ এজেন্সির যাত্রা শুরু

শিক্ষার্থীদের হাতে–কলমে কাজের সুযোগ দেওয়ার জন্য শিক্ষানবিশির ব্যবস্থা করেন আমির। এ জন্য ২০১৮ সালে ‘এডুলাইফ এজেন্সি’ নামে ডিজিটাল এজেন্সির কার্যক্রম শুরু করেন। প্রথমে বেশ কিছু দেশি গ্রাহকের কাজ করে এজেন্সিটি। এরপর বিদেশি গ্রাহকদের কাজ পেতে থাকে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন এডুলাইফ এজেন্সিতে প্রায় ৩০ জনের একটি শক্তিশালী দল, যার মধ্যে ২০ জনই এডুলাইফের শিক্ষার্থী আর অন্যরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও দেশের বাইরে থেকে এডুলাইফের সঙ্গে কাজ করেন। প্রতিষ্ঠানটি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সারা দেশে অনুষ্ঠিত ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলায় ‘শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি’ শ্রেণিতে জেলার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে।

শিশুদের জন্য প্রোগ্রামিং

২০২২ সালের শেষের দিকে এসে আমিরের সবচেয়ে জনপ্রিয় উদ্যোগটি চালু হলো। খাগড়াছড়ির শিশুদের জন্য প্রোগ্রামিং ও স্পোকেন ইংলিশ শেখানোর জন্য ‘এডুলাইফ কিডস’ নামে একটি কর্মসূচি শুরু করেন। এতে ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুরা ধাপে ধাপে কম্পিউটার, স্পোকেন ইংলিশ ও কোডিংয়ে দক্ষ হয়ে উঠবে। খাগড়াছড়ি সদরের বিভিন্ন স্কুলের প্রায় ৬০ জন শিক্ষার্থী এই কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে। এ ছাড়া খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলাতেও কিডস কর্মসূচি শুরু হয়েছে।

সফলতার ভিত্তি

আমির বলেন, ‘আমি যখন যা করেছি বা যা শুরু করি, প্রথমেই তার জন্য একটি সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যমাত্রা তৈরি করি। এরপর সেই লক্ষ্য অর্জনে দক্ষ দল তৈরিতে মনোযোগ দিই। যতক্ষণ না পর্যন্ত দক্ষ একটি দল তৈরি করতে না পারি, ততক্ষণ পর্যন্ত নাছোড়বান্দার মতো লেগে থাকি। এটিই সফলতার মূল ভিত্তি। আমি পুরো দল নিয়ে সফল হতে চাই সব সময়। সাফল্যের স্বাদ সবাইকে পাইয়ে দিতে চাই।’

গুচ্ছগ্রামে কষ্টের কথা এখনো মনে পড়ে

খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার একটি গুচ্ছগ্রামে বেড়ে ওঠা আমির হোসেনের। এখানে মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল—এ চার সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাঙালিদেরও বসবাস। রাবেয়া বেগম ও মো. আবদুল হামিদ শেখের পাঁচ সন্তান। আমির বলেন, ‘মায়ের একান্ত ইচ্ছাতেই আমরা পাঁচ ভাইবোন সবাই পড়াশোনা করতে পেরেছি। গুচ্ছগ্রামের বেশির ভাগ বাসিন্দাই দিন এনে দিনে খেত। নিজেরাও তেমন শিক্ষিত ছিল না, সন্তানদের পড়ালেখা করানোর তেমন চিন্তাও ছিল না। আমার মা দরজির কাজ করতেন, আর বাবার স্বল্প বেতনে আর্মি ক্যাম্পের কাজে সহায়তা করতেন। হাড়ভাঙা পরিশ্রম কাকে বলে, তা তাঁদের দেখেই শিখেছি।’

এত কষ্টের মধ্যেও ছেলেমেয়েদের কখনো পড়াশোনা বন্ধ করেননি আমিরের মা–বাবা। লক্ষ্মীছড়ি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০০২ সালে এসএসসি পাস করে চট্টগ্রামের হাটহাজারী কলেজে ভর্তি হন আমির। একই কলেজে তাঁর বড় ভাইও তখন পড়তেন। দুই ভাই হাটাহাজারীর বালুখালী গ্রামে গৃহশিক্ষক (লজিং মাস্টার) হিসেবে থেকে খাওয়াদাওয়া এবং ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে নিজেদের খরচ চালাতেন। ২০০৫ সালে এইচএসসি ও ২০০৯ সালে বিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রথমে চট্টগ্রামে ও পরে ঢাকায় বিভিন্ন ওষুধ ও প্রসাধনসামগ্রী বিপণনপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আমির। এরপর তো খাগড়াছড়ি ফিরে আসা।

ভবিষ্যৎ লক্ষ্য

২০২৫ সালের মধ্যে একটি পাহাড়ে নিজস্ব অফিস স্থাপন করা এবং কমপক্ষে ১০০ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা আমিরের লক্ষ্য। তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনবল তৈরি করতে স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তা করতে চান আমির।