২০২৫ সাল বিজ্ঞানপ্রেমীদের কাছে বেশ বৈচিত্র্যময় ও উল্লেখযোগ্য বছর। এ বছর বিশ্বের নানা প্রান্তের বিজ্ঞানীরা অনেকটা গোয়েন্দার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছেন, যা কয়েক দশক বা শতাব্দী ধরে অমীমাংসিত ছিল। ইস্টার দ্বীপের বিশালাকার পাথুরে মাথাগুলো পলিনেশীয়রা কীভাবে তৈরি করেছিল, তার রহস্য উন্মোচন থেকে শুরু করে পম্পেই নগরীর অগ্ন্যুৎপাতের আগের আকাশরেখা কেমন ছিল, এমন অনেক রোমাঞ্চকর তথ্য এ বছর সামনে এসেছে। এমনকি পেরুর আন্দিজ পর্বতমালার প্রায় ৫ হাজার ২০০টি রহস্যময় গর্তের উৎস সম্পর্কেও নতুন তথ্য জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সিএনএনের দৃষ্টিতে ২০২৫ সালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু ঐতিহাসিক রহস্য সমাধানের তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
রহস্যময় মমি ও এয়ার–ড্রাইড চ্যাপলেইন
অস্ট্রিয়ার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের গির্জার নিচে ১৭০০ শতাব্দী থেকে একটি মমি সংরক্ষিত ছিল, যাকে স্থানীয় লোকজন এয়ার–ড্রাইড চ্যাপলেইন বা প্রাকৃতিকভাবে শুকিয়ে যাওয়া পাদরি হিসেবে বিবেচনা করত। অক্ষত ত্বক, টিস্যুসহ এই মমিটির অলৌকিক নিরাময় ক্ষমতা রয়েছে বলে জল্পনাকল্পনাও ছিল। সম্প্রতি গির্জার কক্ষটিতে পানি চুইয়ে পড়ার কারণে সংস্কারকাজের জন্য মমিটি সরানো হয়। এই সুযোগে বিজ্ঞানীরা মমিটির সিটি স্ক্যান, টিস্যু বিশ্লেষণ ও রেডিওকার্বন ডেটিং করেন। গবেষণায় দেখা যায়, মমিটি ফ্রান্স জাভার সিডলার ফন রোজেনেগ নামক এক অভিজাত ব্যক্তির। তিনি সন্ন্যাসী হওয়ার পর ওই গির্জার যাজক হয়েছিলেন। বিজ্ঞানীরা কেবল তাঁর মৃত্যুর আসল কারণই খুঁজে পাননি; বরং তাঁর দেহের ভেতরে পাওয়া একটি রহস্যময় কাচের জিনিসের রহস্যও সমাধান করেছেন। জানা গেছে, এর আগে অজানা এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় মরদেহটি সংরক্ষিত করা হয়েছিল।
অদ্ভুত নৌকা ও একটি আঙুলের ছাপ
ডেনমার্কের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করা প্রায় ২ হাজার ৪০০ বছরের পুরোনো হজর্টস্প্রিং নৌকাটি দীর্ঘদিন ধরে প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে এক ধাঁধা ছিল। ১৯২০–এর দশকে ডেনমার্কের আলস দ্বীপের একটি জলাভূমি থেকে উদ্ধার করা নৌকাটিতে প্রচুর অস্ত্র ছিল, যা ইঙ্গিত দেয় এটি যোদ্ধাদের বহন করছিল। কিন্তু নৌকাটি কোথা থেকে এসেছিল বা কারা এতে ছিল, তা জানা ছিল না। নতুন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নৌকাটি আগে যা ভাবা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক দূর থেকে এসেছিল। আক্রমণটি ছিল সুপরিকল্পিত। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো, নৌকার তেলের অবশিষ্টাংশের মধ্যে একটি মানুষের আংশিক আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। গবেষক দলের প্রধান মিকায়েল ফভেলের মতে, ওই সময়ের মানুষের আঙুলের ছাপ পাওয়া অত্যন্ত বিরল এবং এটি সরাসরি সেই যোদ্ধাদের একজনের সঙ্গে আমাদের সংযোগ স্থাপন করে।
মেরু অভিযাত্রী আর্নেস্ট শ্যাকলটনের বিখ্যাত জাহাজ এইচএমএস এনডুরেন্স ডুবে যাওয়ার রহস্যও এ বছর পরিষ্কার হয়েছে। জানা গেছে, জাহাজটি ভাঙা রাডারের কারণে নয়; বরং এর কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে ১৯১৫ সালে ডুবেছিল।
বরফ যুগের নেকড়ে ছানা ও ভুল পরিচয়
২০১১ ও ২০১৫ সালে উত্তর সাইবেরিয়ায় ১৪ হাজার বছরের পুরোনো দুটি নেকড়ে ছানার মমি পাওয়া যায়। টুমাত পাপি নামের মমিগুলোর শরীর রোমে ঢাকা ছিল এবং পাকস্থলীতে শেষ খাবারের অবশেষও ছিল। এত দিন বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিলেন, এগুলো হয়তো মানুষের পোষা প্রাথমিক যুগের কোনো কুকুর বা পোষা নেকড়ে। ২০২৫ সালের জেনেটিক ডেটা ও রাসায়নিক বিশ্লেষণ বলছে, এই ছানাগুলোর সঙ্গে মানুষের কোনো সংস্পর্শই ছিল না। এগুলো ছিল বন্য নেকড়ে ছানা। এই আবিষ্কার কুকুরকে কবে প্রথম পোষ মানানো হয়েছিল, সেই গবেষণায় নতুন মোড় এনে দিয়েছে।
নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর করুণ পরিণতি
১৮১২ সালে ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যখন রাশিয়া আক্রমণ করেন, তখন তাঁর সঙ্গে ছিল প্রায় পাঁচ লাখের বেশি বিশাল সেনাবাহিনী। কিন্তু মাত্র ছয় মাস পরে যখন তারা পিছু হটে ফ্রান্সে ফিরে আসে, তখন মাত্র কয়েক হাজার সেনা জীবিত ছিলেন। এত দিন মনে করা হতো যুদ্ধ, ক্ষুধা, শীত ও টাইফাস মহামারিই এই ধ্বংসযজ্ঞের কারণ। এ বছর এস্তোনিয়ার টার্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রেমি বার্বিয়েরি মৃত সেনাদের দাঁত বিশ্লেষণ করে নতুন তথ্য পেয়েছেন। তাঁরা দাঁতের ভেতর সালমোনেলা এন্টারিকা ও বোররিয়া রিকারেন্টিস নামক ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পেয়েছেন। টাইফাস ছাড়া প্যারাটাইফয়েড জ্বর ও রিল্যাপসিং ফিভার নেপোলিয়নের বিশাল বাহিনীকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে দিয়েছিল।
আলুর বিবর্তন
আজকের দিনের আলুর আদি উৎস খুঁজে পাওয়া গেছে। জানা গেছে, কয়েক লাখ বছর আগের একটি বন্য টমেটোর সঙ্গে আকস্মিক এক সংযোগের ফলে আলুর বিবর্তন শুরু হয়েছিল।
হারিয়ে যাওয়া মহাকাব্য
সংস অব ওয়েড নামক একটি প্রাচীন মহাকাব্য একসময় খুব জনপ্রিয় ছিল, যার খুব সামান্য অংশ টিকে আছে। নতুন পাঠোদ্ধারে দেখা গেছে, এ মহাকাব্যটি আগে যা ভাবা হতো, তার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবধর্মী এবং এতে অতিপ্রাকৃত প্রাণীর আধিক্য ছিল না।
সূত্র: সিএনএন