৬৪ বছরের রেজাউল করিম ফ্রিল্যান্সার

রেজাউল করিম

রাজধানীর নিউ ইস্কাটন এলাকার বাসিন্দা শেখ রেজাউল করিমের বয়স ৬৪ বছর। নিয়ম করে প্রতিদিন অন্তত দুই ঘণ্টা কাটান রমনা পার্কে। ৭ থেকে ১০ কিলোমিটার হাঁটেন অথবা দৌড়ান। অবসরে গান শোনেন। এই রুটিনেই অভ্যস্ত তিনি। দেখে মনে হবে একজন সুখী মানুষ। এই বয়সে তাঁর অবসর যাপন করার কথা। কিন্তু কাজকর্মে এখনো ব্যস্ত থাকেন তিনি। কাজটি অবশ্য তরুণদের। তিনি এই বয়সে মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছেন।

শেখ রেজাউল করিমের জীবনের গল্পটাই এক বিস্ময়। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে তিনি নিজের গল্প শোনান।

২০০৩-০৪ সাল। ঢাকায় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশনে চাকরি করতেন শেখ রেজাউল করিম। সীমিত বেতনে সংসারের ব্যয় মেটানো দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল। বাড়তি আয়ের আশায় চার-পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করে বিনিয়োগ করেন শেয়ারবাজারে। লভ্যাংশ পুনর্বিনিয়োগ এবং কিছু নতুন বিনিয়োগও করেন। ২০১০ সালের শুরুতে সেই বিনিয়োগ দাঁড়ায় প্রায় ৬০ লাখ টাকায়। ব্রোকারেজ হাউস থেকে ঋণ নিয়ে আরও ১৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন রেজাউল করিম। ওই বছরের জুলাই মাসে তাঁর বিনিয়োগের বাজারমূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ১৪ লাখ টাকায়।

নিজেকে সফলতম মানুষদের একজন মনে হচ্ছিল শেখ রেজাউল করিমের। কিন্তু ওই বছরেই তাঁর জীবনে আসে ভয়ংকরতম ধাক্কা। হঠাৎ শেয়ারবাজারে দরপতন শুরু হয়। একই সময়ে জিবিএস রোগে (গুলেন ব্যারি সিনড্রোম) আক্রান্ত হন তাঁর স্ত্রী হাসানাত উন নাহার। এটি স্নায়ুজনিত রোগ, এতে দেহের মাংসপেশি ধীরে ধীরে শক্তি হারিয়ে ফেলে। তাঁর সুস্থ স্বাভাবিক স্ত্রী, মাত্র তিন-চার দিনের মধ্যে পুরোপুরি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। সব ফেলে ছোটাছুটি শুরু হলো স্ত্রীকে নিয়ে। এর মধ্যে শেয়ারবাজারের পতন আরও বাড়ল। তাঁর বিনিয়োগ কমে প্রায় এক-দশমাংশ হয়ে পড়ে। তখন ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য ‘ফোর্সড সেলের’ (জোরপূর্বক বিক্রি) মাধ্যমে তাঁর সব শেয়ার বিক্রি করে দেয় ব্রোকারেজ হাউস। নিঃস্ব হয়ে পড়েন রেজাউল।

মাসে গড়ে লাখ টাকার ওপরে আয় হয় আমার। অবসর জীবনটাকে উপভোগ করি বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে। ফ্রিল্যান্সিং তার মধ্যে একটি। মাসে কত টাকা উপার্জন করছি, এর চেয়ে আমার কাছে সুস্থভাবে বেঁচে থাকাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।
রেজাউল করিম

এদিকে সরকারি চাকরি থেকে অবসরের সময়ও এগিয়ে আসতে থাকে। অবসরজীবনে কী করবেন ভেবে ২০১৭ সালে গরুর একটা খামার শুরু করেন নিজ এলাকা বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার শৈলদাহ গ্রামে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তিনি অবসরে যান। আগে থেকেই তাঁর ধ্যানে-জ্ঞানে ছিল খামার। এটি ভবিষ্যতের অবলম্বন হিসেবে ভেবেছিলেন। কিন্তু করোনা মহামারি তাঁর সব পরিকল্পনা এলোমেলো করে দেয়। বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। তিতাস অফিস থেকে ঋণ নিয়েছিলেন ৩০ লাখ টাকা। তাই অবসরে পাওয়া এককালীন টাকা থেকে সেটা কেটে নেওয়া হয়। তখন তিনি ১৪ লাখ টাকার মতো পান।

ল্যাপটপে কাজ করছেন রেজাউল করিম
ছবি: প্রথম আলো

শেখ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শেয়ারবাজার ও খামার দুটোতেই যে পরিমাণ লোকসান দিয়েছি, তাতে আমার বহুদিন ঘুম আসেনি। টাকার শোক তো বড় শোক। শুধু দীর্ঘশ্বাস নিতাম। আমি লোভে পড়েছিলাম। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। ভেবেছি আজ না কাল ঠিক হবে, এভাবে ভাবতে ভাবতেই সব শেষ। করোনার সময় খামারের গরুগুলোও কম টাকায় বিক্রি করে দিতে হয়েছে। লকডাউনে গরুকে খাওয়ানোই মুশকিল হয়ে পড়েছিল।’

৬১ বছর বয়সে প্রশিক্ষণ

একসময় করোনায় আক্রান্ত হলেন শেখ রেজাউল করিম। সারা দিন শুয়ে-বসে সময় কাটতে থাকে। সময় কাটাতে শুরু করেন ইউটিউবে ভিডিও দেখা। একপর্যায়ে ডেটা এন্ট্রি বিষয়ে একজন মেন্টরের কাছে প্রশিক্ষণ নেন। কিন্তু মেন্টর নিজেই করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় সেই যাত্রাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তবে গ্রুপে হোমওয়ার্ক করার সময় একজনের কাছে জানতে পারেন স্কিলআপার নামের এক প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে। এই প্রতিষ্ঠানে অনলাইনের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিং শেখানো হয়। সেখানে তিনি ২০২২ সালে ভর্তি হন। তখন তাঁর বয়স ৬১ বছর। ভর্তির আগে অবশ্য স্কিলআপারের আগে ধারণ করা (রেকর্ডেড) কোর্স কিনে ভিডিও দেখা শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু কম্পিউটারে কাজের ওপরে তাঁর তেমন কোনো দক্ষতা বা জানাশোনা ছিল না। তাই রেকর্ডেড কোর্সের তেমন কিছুই বুঝতেন না। তবে অনলাইনে সরাসরি (লাইভ) কোর্সে যোগ দেওয়ার পরে তিনি বুঝতে শুরু করেন।

আরও পড়ুন

প্রথম প্রশিক্ষণে নিজেকে খুঁজে পেতে শুরু করেন শেখ রেজাউল করিম। গুগল অ্যাডস, গুগল অ্যানালিটিকস, গুগল মার্চেন্টস সেন্টার (শপিং অ্যাড) ইস্যু ফিক্সিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে পান। শুরু হয় নতুন পথচলা। মার্কেটপ্লেস ফাইভআরে (অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং কাজ দেওয়া-নেওয়ার ওয়েবসাইট) আগেই অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন রেজাউল। ইতিমধ্যে ৩৫টি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের ওপর কাজ করেছেন তিনি।

আরও পড়ুন

নিজের সন্তানের চেয়েও বয়সে ছোট মো. সজীব মিয়ার সঙ্গে একত্রে কাজ করেন রেজাউল করিম। কম্পিউটারে তেমন দক্ষতা নেই নিজের। তাই সজীবের সহযোগিতা নিয়ে কাজ করতে হয়। সজীবও ওই কোর্সের ছাত্র ছিলেন। রেজাউল করিম বর্তমানে আপওয়ার্ক মার্কেটপ্লেসে বেশ কিছু কাজ সম্পন্ন করেছেন।

এ বছর রেজাউল করিম আপওয়ার্কের স্বীকৃত টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার হয়েছেন। কমপক্ষে ৯০ শতাংশ কাজের সফলতা, শেষ ১২ মাসে কমপক্ষে এক হাজার ডলার আয়, শেষ তিন মাসে অ্যাকাউন্টে সক্রিয় থাকা, গ্রাহকদের সন্তুষ্টিসহ বিভিন্ন শর্ত পূরণ করলেই তিনি টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার হন।

আরও পড়ুন

শেখ রেজাউল করিমের স্ত্রী হাসানাত উন নাহার একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। তাঁদের দুই ছেলেমেয়ে। মেয়ে রওনক রেজা ২৬ বছর বয়সী। ছেলে ইশমাম রেজা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। বয়স ২৪ বছর। স্ত্রী এখন একটু হাঁটাচলা করতে পারলেও অন্য কাজ করতে পারেন না।

গত ২০ জানুয়ারি রেজাউল করিম ৬৫ বছরে পা রেখেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাসে গড়ে লাখ টাকার ওপরে আয় হয় আমার। অবসর জীবনটাকে উপভোগ করি বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে। ফ্রিল্যান্সিং তার মধ্যে একটি। মাসে কত টাকা উপার্জন করছি, এর চেয়ে আমার কাছে সুস্থভাবে বেঁচে থাকাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।’

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন