২৭ বছর আগে ঘূর্ণিঝড়ের সময় যেভাবে অ্যামেচার রেডিও দিয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল

গাড়িতে অ্যামেচার রেডিওর সরঞ্জাম নিয়ে মুনিম হোসেন। এটাই ভ্রাম্যমাণ বেতারকেন্দ্রের কাজ করে। ১৯৯৭ছবি: সংগৃহীত

অ্যামেচার রেডিও একটি শখ। একটু কারিগরি বিষয় বটে, কত কম শক্তির ট্রান্সমিটার দিয়ে কত দূরে সংকেত বা সিগন্যাল পাঠানো যায়, মূলত সেটাই এই শখের প্রধান কার্যক্রম। সেটা হতে পারে পাড়ার দুই বন্ধুর মধ্যে তারহীন মাধ্যমে যোগাযোগ, দেশ থেকে দেশান্তরে কিংবা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে থাকা নভোচারীদের সঙ্গে অথবা এলিয়েনের সংকেত ধরে সেটা ডিকোড করার স্বপ্ন!

আমরা বেতার সংকেতের (রেডিও সিগন্যাল) বিভিন্ন কম্পাঙ্ক (ফ্রিকোয়েন্সি) ব্যবহার করে থাকি, সেটা অ্যামেচার স্যাটেলাইট কিংবা ইন্টারনেটের মাধ্যমেও হতে পারে। যদিও আমরা সারাক্ষণই বন্ধুত্ব কিংবা অদরকারি কথাবার্তা কিংবা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকি, কিন্তু দুর্যোগকালে আমাদের এই ব্যক্তিগত শখ সমাজের কাজে লাগে। যেহেতু অ্যামেচার রেডিওর হবিস্টরা প্রত্যেকেই এক বা একাধিক ট্রান্সমিটার-রিসিভার নিজেই বাসায় বসে রক্ষণাবেক্ষণ করেন, তাই দুর্যোগকালে সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগব্যবস্থা যখন ব্যাহত হয়, তখন আমরাই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

আজ তেমনি একটি ঘটনার কথা বলব, যেটা ঘটেছিল ১৯৯৭ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়। দিনটা ছিল শুক্রবার, দুপুরে আবহাওয়া অফিস যখন জানাল ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত বেড়ে গিয়ে ১০ নম্বর হতে চলছে এবং সাইক্লোন হানা দিতে পারে নোয়াখালী থেকে কক্সবাজার উপকূলজুড়ে, তখনই আমরা কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের রেডিওর যন্ত্রপাতি যা আছে, তা নিয়ে বের হয়ে পড়ব। আমরা যাঁরা শখের বশে অ্যামেচার রেডিও চালাই, তাঁদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা সাংকেতিক নম্বর রয়েছে। অ্যামেচার রেডিও অপারেটরদের একটি পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স নিতে হয় এবং সরকার থেকে একটি ‘কল সাইন’ বা পরিচিতি বরাদ্দ করা হয়, যা একজনের জন্য সারা জীবন প্রযোজ্য থাকতে পারে। আমার বাংলাদেশের কল সাইন এ২১ আর এবং যুক্তরাষ্ট্রে এফসিসির বরাদ্দ করা কল সাইন কেএফ ৫১ ভিএল।

আবার ফিরে আসি ১৯৯৭ সালের সেই দুর্যোগের ঘটনায়। আমিনুল কাওসার দিপু (এস ২১ ডি) প্রস্তাব দিলেন আমরা রেড ক্রিসেন্টের সঙ্গে যৌথভাবে যেতে পারি এবং সেখান থেকেই সরকারের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) ও অন্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে। মঞ্জু (এস ২১ এএম), সোহেল (এস ২১ এস) ও আনোয়ার (এ ২১ এল) যোগ দিলেন কেয়ার বাংলাদেশের ভ্রাম্যমাণ দলের সঙ্গে। মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যেই আমরা রেড ক্রিসেন্ট, কেয়ার ইত্যাদি সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই করে নিজেদের রেডিওস্টেশনগুলো নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বেরিয়ে পড়ি।

ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর উপদ্রুত এলাকা থেকে অ্যামেচার রেডিও দিয়ে যোগাযোগ করছেন আমিনুল কাওসার। ১৯৯৭
ছবি: সংগৃহীত

আমি আর দিপু ভাই, রেড ক্রিসেন্টের দুটি গাড়িতে আমাদের ওয়্যারলেস মোবাইল স্টেশন স্থাপন করি ও কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাই। মনে রাখতে হবে, সে সময়ে মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক সবে বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোয় চালু হয়েছে। ইন্টারনেট এখনকার মতো সর্বস্তরে যায়নি।

ঠিক হলো আমরা তিনটি গাড়িতে ট্রান্সমিটার (প্রেরকযন্ত্র) চালু রাখব এবং ঢাকাতে তুলি (এস ২১ টি), নিজাম ভাই (এস ২১ বি) ও প্রয়াত শহীদ ভাই (এস ২১ এ) থাকবেন। আমরা বিভিন্ন স্থান থেকে তাঁদের সঙ্গে ভিএইচএফ বা এইচএফে (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি বা হাই ফ্রিকোয়েন্সি) যোগাযোগ করব এবং তাঁরা সিপিপি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো ও অন্যান্য সংস্থায় আমাদের তথ্য রিলে করবেন।

আমরা ভিএইচএফে কুমিল্লার কাছাকাছি পর্যন্ত ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারি। ওদিকে সারা বিশ্বে অ্যামেচার রেডিও ওয়ার্ল্ডে প্রচার হয়ে গেছে আমরা বাংলাদেশ থেকে ঘূর্ণিঝড় অনুসরণ করছি। অ্যামেচার রেডিও ওয়ার্ল্ড এইচএফ স্টেশনে আমাদের পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছে।

বিশ্বের কয়েকটা জায়গা থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের হালনাগাদ খবরগুলো আমরা পেলাম, যা কিনা আমাদের আবহাওয়া অফিস তখনো প্রচার করেনি। তখন তো গুগল মামাও ছিল না।

সদর দপ্তর থেকে নির্দেশ দেওয়া হলো আমরা যেন কুমিল্লা রেস্টহাউসে ঢুকে পড়ি। কেননা, সাইক্লোন আঘাত হানা শুরু করেছে, আমাদের নিজেদের নিরাপত্তা সবার আগে দেখতে হবে। কয়েক ঘণ্টা পরে আবার বেরিয়ে পড়ি। তখনো অন্ধকার, নোয়াখালী পার হওয়ার আগেই প্রচণ্ড ঝড়ে পড়লাম। ঘূর্ণিঝড়ের চোখ (আই পয়েন্ট) তখন নোয়াখালী থেকে সরে আরও দক্ষিণে চলে গেছে, আমরা সেটাই অনুসরণ করছি। সামনের গাড়ি হঠাৎ যোগাযোগ–বিচ্ছিন্ন হলো। ভিএইচএফে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না, ওটাতে ডেলটা ছিল। ঢাকার কন্ট্রোল স্টেশনে ছিলেন তুলি। তিনি আমাদের বার্তাগুলো রেড ক্রিসেন্ট ও অন্যান্য সংস্থায় টেলিফোনের মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছিলেন।

রাতে আয়নমণ্ডল (আয়নোস্ফিয়ার) অনেক ওপরে চলে যায়। যে কারণে কাছাকাছি দূরত্বে এইচএফ যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। কেবল দূরের স্টেশনগুলোর সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতে পারছিলাম। যাঁরা নিয়মিত এএম (অ্যামপ্লিচ্যুড মডিউলেশন) রেডিও শুনে থাকেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন রাতেই কেবল দূরের স্টেশনগুলো ধরা যায়। তাই ঢাকার সঙ্গে তখন আমরা যোগাযোগ হারালাম।

ভারত থেকে প্রয়াত অমলদা (ভিইউ২ এপি) সারা রাত জেগে ছিলেন। আমাদের সংকেত গ্রহণ করে তিনি সেটা ঢাকার কন্ট্রোলে স্টেশনে রিলে করতে থাকলেন। একটা সময় সেটাও সম্ভব হচ্ছিল না। তখন আমাদের গাড়ি থেকে পাঠানো সংকেত ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশের স্টেশন আমাদের বার্তাগুলো কপি করে আবার ঢাকায় রিপিট করে জানিয়ে দিচ্ছিল। এভাবে আমরা সারাক্ষণ যোগাযোগ বজায় রাখতে পারছিলাম।

১৯৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির সংক্ষিপ্ত তালিকা
ছবি: সংগৃহীত

সকালে যখন চট্টগ্রাম পৌঁছাই, তখন সেখানে দেখলাম ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে সবকিছু লন্ডভন্ড। কোথাও বিদ্যুৎ নেই এবং ফোনসহ সব পাবলিক যোগাযোগ বন্ধ। ওয়্যারলেসের মাধ্যমে আমরা কাজ চালাচ্ছিলাম। চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সভা শেষে সিদ্ধান্ত হলো, দিপু ভাই আগে কক্সবাজার চলে যাবেন। কেননা, ও দিকটা সম্পূর্ণ যোগাযোগ–বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

আমি ছিলাম রেড ক্রিসেন্টের আজমতের গাড়িতে। আমরা আনোয়ারা উপজেলা ও কিছু গ্রাম কাভার করে তারপর কক্সবাজারের দিকে এগোচ্ছিলাম। আমাদের প্রধান কাজই ছিল ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি নিজ চোখে দেখে রিপোর্ট করা, যাতে বিভিন্ন জায়গা থেকে সহায়তা সঠিকভাবে দ্রুত আসতে পারে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বহু জায়গায় গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ, এদিক-ওদিক করে বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে সরাসরি তথ্যগুলো আমরা পাঠাতে পেরেছিলাম।

আনোয়ারা পার হয়ে একটা গ্রামে এক মর্মান্তিক ঘটনার সম্মুখীন হই। ওখানকার একটা পরিবার দুই শিশুসহ সাইক্লোন শেল্টারে উঠে গেছে, কিন্তু মেয়েটাকে ওরা ঘরে রেখে যায় গরু–ছাগল দেখার জন্য। সে মেয়েটা নাকি কোথায় ভেসে গেছে। সারা জীবন এ ঘটনা মনে থাকবে।

দিপু ভাইয়ের দলটি আগে কক্সবাজারে পৌঁছায়। সেখানকার টিঅ্যান্ডটির টেলিফোন টাওয়ার ঝড়ে নষ্ট হয়ে গেছে, তাই পুরো কক্সবাজার সারা দেশ থেকে যোগাযোগ–বিচ্ছিন্ন। খবরটা আমার কাছে দিপু ভাই পাঠালেন, আমি ঢাকায় পাঠালাম, ঢাকা থেকে টিঅ্যান্ডটির প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হলো।

ওদিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংবাদে তখনো কোনো খবর প্রচার করা হয়নি। আনোয়ার ভাই ঠিক সন্ধ্যা ছয়টায় ঢাকার মাইক্রোওয়েভ অন রাখতে বললেন এবং উনি ব্যাকআপ পাওয়ারের ব্যবস্থা করে চট্টগ্রাম থেকে বিটিভির জন্য নিউজ ফিড পাঠালেন, যেটা বিটিভি রাতে প্রচার করে।

এভাবেই দুর্যোগের সময় যখন প্রচলিত যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, তখন অ্যামেচার রেডিওর স্বেচ্ছাসেবকেরা বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করে জরুরি সহায়তা করতে পারেন। প্রচুর চলচ্চিত্র রয়েছে, যেসবে দেখা যায় সারা বিশ্ব যখন যোগাযোগ–বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, তখন প্রত্যন্ত স্থান থেকে অ্যামেচার রেডিও অপারেটররা তারহীন যোগাযোগ শুরু করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে মুনিম হোসেনের গাড়িতে অ্যামেচার রেডিওর সরঞ্জাম
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের দেশে অ্যামেচার রেডিও লাইসেন্স প্রথম উন্মুক্ত হয় ১৯৯১ সালে, চট্টগ্রামে জলোচ্ছ্বাসের ঘটনার পরে। এর আগে আমরা কেবল ‘লিসেনার’ হিসেবেই এই শখ মেটাতাম। ১৯৯৭ থেকে ২০২৪—২৭ বছর পর বাংলাদেশ এখন যোগাযোগব্যবস্থায় অনেক উন্নত। কিন্তু অ্যামেচার রেডিওর স্বেচ্ছাসেবকের প্রয়োজন এখনো প্রচুর। যদি দু-তিন দিন টানা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে, তবে মুঠোফোনের টাওয়ারগুলো নেটওয়ার্ক সচল রাখতে পারবে না। যদি কখনো ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের মতো শহরে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়, তখন এই অ্যামেচার রেডিওর স্বেচ্ছাসেবকেরা বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু যোগাযোগ রক্ষা করতে পারবেন।

অনেকের হয়তো মনে আছে ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিয়ন্সে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে সারা শহর তলিয়ে যায়। সেটা ঘটেছিল ক্যাটরিনা ঝড়ের আঘাতে। তখন কিন্তু মুঠোফোন ও অন্য সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, অ্যামেচার রেডিওর কিছু স্বেচ্ছাসেবক জীবন বাজি রেখে যোগাযোগ রাখতে সাহায্য করেছিলেন।

আশা করি, আমাদের দেশ কখনো সে রকম ভয়াবহ দুর্যোগে পড়বে না এবং বর্তমান প্রজন্মের অ্যামেচার রেডিও অপারেটররা প্রস্তুত থাকবেন যেকোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায়।

মুনিম হোসেন রানা: যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী পদার্থবিজ্ঞানী ও অ্যামেচার রেডিও অপারেটর।