আশিকের সঙ্গে এখন ৩০০ কর্মী

নিজের প্রতিষ্ঠান লাইভ শপিংয়ে আশিক খান

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের লাইভে এসে পণ্য বিক্রি নতুন কিছু নয়। কিন্তু আশিক খানকে এই কাজের জন্য কটু কথা শুনতে হলো। কারণ, তিনি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এসেছেন। ‘অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করে ফেসবুক লাইভে কাপড় বিক্রি করে!’ আশপাশের অনেকের বিরূপ কথাই শুনতে হয়েছিল আশিককে।

তবে আশিকের নিজে কিছু করার তাগিদ ছিল। লাইভ শপিং নামে ফেসবুক পেজ খুললেন। লাইভে পোশাক উপস্থাপনায় অভিনবত্ব এনেছিলেন। সাধারণত ফেসবুক লাইভে যেমন পোশাক দেখা যায়, বাস্তবে পোশাকটা হুবহু তেমন থাকে না। আশিকের ক্ষেত্রে ক্রেতা লাইভে পোশাক যেমন দেখতেন, হাতেও পেতেন তেমন। সুন্দর বাচনভঙ্গি ও সাবলীল ভাষায় মানুষকে বোঝানোর গুণের কারণে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। আশিক খান আজ একজন সফল তৈরি পোশাক উদ্যোক্তা। অনলাইনে যেমন আছে তাঁর উদ্যোগ, তেমনি আছে ছয়টি দোকান। আর আছে একটি তৈরি পোশাক কারখানাও।

অক্সফোর্ডে অনুপ্রেরণা

আশিকের উদ্যোগগুলো নিয়ে বলতে গেলে যেতে হবে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্বখ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আশিক লক্ষ করেন, যুক্তরাজ্যের বাজারে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকগুলো খুব বেশি দামে বিক্রি হয়। অন্যদিকে পোশাক যাঁরা বানান, তাঁরা ন্যায্য মজুরিটুকুও পান না। আশিক কম দামে কাঁচামাল সংগ্রহ করে পোশাক তৈরির পরিকল্পনা করলেন। পাঁচ বছর আগে শুরু করেন সেই উদ্যোগের বাস্তবায়ন। এখন ২৭ বছর বয়সী আশিক খানের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৩০০ জন কর্মী কাজ করছেন আশিকের বেড়ে ওঠা যশোর শহরে। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। বাবা শফিকুর রহমান ছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী, মা ফাতেমা রহমান, একজন নারী উদ্যোক্তা। ফাতেমা রহমান ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতির পুরস্কার পেয়েছেন। চলতি বছর শিল্প মন্ত্রণালয়ের পুরস্কারও পেয়েছেন। আশিক খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মা–ই আমার অনুপ্রেরণা। তাঁকে দেখে ব্যবসার অনেক কিছু শিখেছি।’

আশিক খান
সংগৃহীত

ছাত্রজীবনে উদ্যোক্তা হওয়ার হাতছানি

২০১০ সালে বিজ্ঞান বিভাগে যশোরের বাদশাহ ফয়সাল ইসলামী ইনস্টিটিউট থেকে এসএসসি এবং ২০১২ সালে যশোর শিক্ষা বোর্ড মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন আশিক। দুটিতেই ফলাফল জিপিএ–৫। ২০১২ সালে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু ছয় মাসের মধ্যে তাঁর ইচ্ছা জাগে সফটওয়্যার প্রকৌশল পড়ার। আশিক বলেন, ‘ঢাকার ড্যাফোডিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। পাশাপাশি নিজের সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরু করি। নাম দিই অ্যাডভার্ট লিমিটেড।’ ২০১৭ সালে স্নাতক হওয়ার পর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও ব্রিটিশ সংস্কৃতিবিষয়ক কোর্সের জন্য বৃত্তি পান আশিক। সে বছরই আশিক বিয়ে করেন ইমরাত ইসলামকে। তাঁদের এক ছেলে ওয়াফি খানের বয়স এখন দুই বছর। অক্সফোর্ডের কোর্স সম্পন্ন করে ২০১৮ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন আশিক।

সফটওয়্যার থেকে পোশাক উদ্যোক্তা

ড্যাফোডিলে পড়ার সময় নিজের কিছু জমানো টাকা ও মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে ঢাকার ইস্টার্ন প্লাজায় ছোট একটি অফিসে অ্যাডভার্ট লিমিটেডের কাজ শুরু করেন আশিক। তখন ছয়জন কর্মী ছিল তাঁর প্রতিষ্ঠানে। ওয়েব ডিজাইন, ই-কমার্সের ওয়েবসাইট, গ্রাহক ব্যবস্থাপনার সফটওয়্যার সেবা দেওয়া হতো এই প্রতিষ্ঠান থেকে। এই সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি ব্যাংক থেকে এক কোটি টাকা ঋণ পান আশিক। অ্যাডভার্টের অফিস এবার চলে যায় বাংলামোটরে। ৪০ জন কর্মী নিয়ে বড় পরিসরে কাজ শুরু করেন আশিক। ভালোই চলছিল। কিন্তু ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরু হলে গ্রাহক কমতে থাকে। টাকাপয়সা আটকে যায়। বিকল্প ভাবতে হয় আশিক খানকে।

২০২০ সালে আশিক ভাবলেন নিজে সরাসরি তৈরি পোশাক বিক্রি করবেন। প্রস্তুতি হিসেবে মার্চ মাসে বাসায় বসে ফেসবুক লাইভে এসে অনলাইনে কেনাকাটা নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। আশিক বলেন, ‘ধীরে ধীরে বিভিন্ন জায়গা থেকে পোশাক এনে বিক্রি করা শুরু করি। ভালোই চলছিল। এভাবে ব্লেজার সরবরাহের একটা অর্ডার পাই।’ ব্যাংক থেকে পাওয়া ঋণের কিছু টাকা ছিল তাঁর হাতে। ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন পোশাকে। কিন্তু ব্লেজার নেওয়ার পর সেই প্রতিষ্ঠান উধাও হয়ে যায়।’

একটি আয়োজনে কর্মীদের সঙ্গে আশিক খান
সংগৃহীত

ঘুরে দাঁড়ানো

হতাশ হয়ে পড়েন আশিক খান। সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের সার্ভার বিক্রি করে দেন। এদিকে অফিসের ভাড়া বকেয়া পড়ে যায়। মালিক পুরো অফিস নিয়ে নেন। আশিক অনুরোধ করে দুটি কক্ষ রাখতে পারেন। এখানে আশিক লাইভ শপিংয়ের দোকান চালু করেন। করোনার শেষে মানুষ ছোট এই দোকানে আসতে থাকেন। ধীরে ধীরে বিক্রি বাড়ে। ক্রেতাদের মধ্যে তরুণেরাই বেশি।

লাইভশপিং নামেই অনলাইনে ও বাংলামোটরের দোকানে পোশাক বিক্রি করতে থাকেন আশিক। এরপর ২০২১ সালে বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে আরেকটি দোকান খোলেন। ২০২২ সালে মিরপুর ২ নম্বরে মিরপুর শপিং সেন্টারে বড় আকারে দোকান খোলা হয়। ২০২৩ সালে যমুনা ফিউচার পার্ক এবং চট্টগ্রাম, উত্তরা ও সিলেটে চারটি দোকান চালু করেন আশিক। ওদিকে ফেসবুকে লাইভ শপিংয়ের পেজ তো আছেই। সেখানে ফলোয়ার ২০ লাখ। ২ লাখের বেশি নিবন্ধিত ক্রেতা।

অ্যাডভার্ট নামের সেই সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানটি এখনো আছে আশিকের। তবে সেটা এখন লাইভ শপিংয়ের কারিগরি সেবা দিয়ে থাকে। আর কয়েকজন পুরোনো গ্রাহকের কাজ করে। আশিক খান সফলতা ও খ্যাতি পেয়েছেন লাইভ শপিং থেকে। আশিক বলেন, ‘মানিকগঞ্জের মানিক যা পরে—ম্যানহাটনের মাইকেলও যেন একই পণ্য স্বাচ্ছন্দ্যে পরতে পারে। লাইভ শপিংয়ের উদ্দেশ্য এটাই।’

সবার জন্য সুলভে দেশি পোশাক

পোশাকশিল্প ও সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান চালানোর পাশাপাশি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন আশিক। বিভিন্ন আয়োজনে ব্যবসাবিষয়ক আলোচনা করে অনুপ্রাণিত করেন তরুণ উদ্যোক্তাদের। ব্যবসা খাতে আরও তরুণ আসুক, এটাই চান আশিক খান। আশিকের পরিকল্পনা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যাওয়া। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশি ব্র্যান্ডর পোশাক কম দামে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চাই। পাশাপাশি দেশের মানুষও যেন কম খরচে ভালো মানের পোশাক পরতে পারে, এটা চাওয়া।’