ই-কমার্স অর্থনীতি বাজেটে অগ্রাধিকারের সময় এখন
বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের অর্থনীতির স্বপ্ন বাস্তবায়নে অগ্রসর, তখন সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাতগুলোর একটি হলো ই-কমার্স। এই খাতের উদ্যোক্তা, কর্মসংস্থান, প্রযুক্তিনির্ভরতা ও বৈশ্বিক বাজার সংযোগ—সব মিলিয়ে এটি এখন আর বিকল্প নয়, বরং নতুন অর্থনীতির কেন্দ্রে চলে এসেছে। এ কারণে এই মুহূর্তে ‘ই-কমার্স অর্থনীতি’ ধারণাটিকে জনপ্রিয় করা ও বাজেট প্রণয়নে সেই আলোকে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।
ভিশন ২০৩০ ও ই-কমার্স অর্থনীতি
ভিশন ২০৩০-এ বাংলাদেশের লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল অর্থনীতি, কর্মসংস্থান বাড়ানো, তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করা ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নতুন খাত তৈরি। এই প্রতিটি লক্ষ্য পূরণে ই-কমার্স হতে পারে একটি প্রধান সহায়ক খাত। তাই বাজেট প্রস্তাবনায় ই-কমার্সকে একটি আলাদা অর্থনৈতিক খাত হিসেবে বিবেচনা করা দরকার—আমরা একে বলছি ই-কমার্স অর্থনীতি।
বর্তমান বাস্তবতা ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত
বাংলাদেশে প্রায় ৮০ হাজারের বেশি ই-কমার্স ও এফ-কমার্স ব্যবসা চলছে, যার বড় অংশ তরুণ ও নারী উদ্যোক্তা পরিচালনা করছেন (সূত্র: বেসিস ও ই-ক্যাব)। এই খাত থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫-৬ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে (আঙ্কটাড ২০২৩)। ২০২২ সালে দেশের ই-কমার্স খাতের আকার দাঁড়ায় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা (বিটিআরসি ও গুগলের যৌথ প্রতিবেদন)।
ভারত ২০২৩ সালে ই-কমার্স থেকে ৮ হাজার ৩০০ কোটি ডলার এবং ভিয়েতনাম ১ হাজার ৪৫০ কোটি ডলার আয় করেছে। তাদের বাজেটে ই-কমার্স স্পেসিফিক সাবসিডি ও ফাইন্যান্স স্কিম রাখা হয় (সূত্র: বিশ্বব্যাংক ২০২৩)। বাংলাদেশে এখনো কোনো স্টার্টআপ তহবিল, কর ছাড় অথবা স্কিল সাপোর্ট নেই, যা ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা।
বাজেট ২০২৫-২৬: ই-কমার্স খাতের জন্য ৫টি বাস্তবভিত্তিক দাবি
স্টার্টআপ ইনসেনটিভ ও ডিজিটাল ঋণ—ভারতীয় এসআইডিবিআইয়ের মতো মডেলে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য কোল্যাটারাল-ফ্রি ই-কমার্স ব্যবসা ঋণ।
মাইক্রো উদ্যোক্তাদের জন্য ভ্যাট ছাড়/সহজ নিবন্ধন—টার্নওভার কর ২-৩ শতাংশ করে সহজ রিটার্ন পদ্ধতি চালু।
ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স রপ্তানি সহায়তা—কাস্টমস ডিজিটালাইজেশন, রপ্তানি কোড ও রপ্তানিকারক স্বীকৃতি।
ই-কমার্স দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প—প্রতিবছর ১ লাখ উদ্যোক্তা ও কর্মীকে শপিফাই, ডিজটাল লজিস্টিকস, প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফি ইত্যাদিতে প্রশিক্ষণ।
লেনদেন নিরাপত্তা ও ডিজিটাল লেনদেন প্রণোদনা—ডিজিটাল লেনদেনে ২ শতাংশ প্রণোদনা ও সাইবার ঝুঁকি মোকাবিলায় নিরাপত্তা বৃদ্ধি।
ই-কমার্সে দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রস্তাব
শপিফাই বা ওয়েবসাইট তৈরি, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম বিপণন, প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফি ও মোবাইল এডিটিং, কাস্টমার সার্ভিস ও বিক্রয় যোগাযোগ, গুগল অ্যাডস ও সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (এসইও), ডিজিটাল লজিস্টিকস ও ফুলফিলমেন্ট, ইনভেনটরি ও অর্ডার ম্যানেজমেন্ট, ডেটা অ্যানালিটিকস ফর ই-কমার্স, অ্যামাজন, এটসি ও ইবে লিস্টিং ও ফুলফিলমেন্ট, ক্রস-বর্ডার ট্যাক্স ও কাস্টমস প্রসেসিং, পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবস্থাপনা ও রিফান্ড পলিসি, বিজনেস লাইসেন্সিং ও বিডিআইডি প্রসেস, ই-কমার্স আইন ও গ্রাহক অধিকার, উদ্যোক্তা শিক্ষা ও বিজনেস মডেলিং, গ্লোবাল মার্কেটপ্লেস আর্কিটেকচার ও অপারেশনস, প্রোডাক্ট ক্যাটালগ ম্যানেজমেন্ট ও মাল্টি-লিঙ্গুয়াল লিস্টিং, গ্লোবাল প্রাইসিং ও এক্সচেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি, কোয়ালিটি কন্ট্রোল ও স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন, ওয়্যারহাউস ও ইনভেনটরি অটোমেশন, স্মার্ট প্যাকেজিং ও সাসটেইনেবল শিপিং, রিটার্নস ও রিভার্স লজিস্টিকস, ক্রস-বর্ডার এক্সপোর্ট ডকুমেন্টেশন ও এইচএস কোড ব্যবস্থাপনা, ফ্রড ডিটেকশন ও রিস্ক মনিটরিং, কনজ্যুমার প্রটেকশন ও ডিজিটাল ল’কমপ্লায়েন্স, গ্লোবাল ডিজিটাল মার্কেটিং (এসইও, এসইএম, ই-মেইল, অ্যাফিলিয়েট), ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং ও সোশ্যাল কমার্স, ট্রাস্ট বিল্ডিং ও রেপুটেশন ম্যানেজমেন্ট, কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স অ্যানালিটিকস, লয়ালটি স্ট্র্যাটেজি ও ই-কমার্স সিআরএম, বিজনেস ইন্টেলিজেন্স ও ড্যাশবোর্ডিং, ভেন্ডর ম্যানেজমেন্ট ও স্ট্র্যাটেজিক সোর্সিং এবং ওমনিচ্যানেল ও ডিটুসি (ডাইরেস্ট টু কাস্টমার) এক্সিকিউশন।
এই মুহূর্তে যখন দেশের বাজেট প্রণয়নের প্রক্রিয়া চলছে, তখন ই-কমার্স খাতকে শুধু করযোগ্য নয়, নীতিসহায়ক ও প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। ই-কমার্স অর্থনীতি যদি আজ বাজেটে জায়গা না পায়, তবে আমরা শুধু একটি সম্ভাবনাকে হারাবো না; বরং ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধির দিকটাই উপেক্ষা করব।
ড. মোহাম্মদ নূরুজ্জামান: ড্যাফোডিল ফ্যামিলির গ্রুপ সিইও এবং গ্লোবাল এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ নেটওয়ার্ক-বাংলাদেশের কোষাধ্যক্ষ