দেশে বছরে ৩০ লাখ টন ই-বর্জ্য, মুঠোফোন থেকেই সাড়ে ১০ লাখ টন

গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) নাজনীন নাহার, শাফকাত হায়দার, রেজাউল করিম ও সৈয়দ আখতার হোসেন
সংগৃহীত

বাংলাদেশ প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার জন্য কাজ করছে। কিন্তু স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য ব্যবহৃত প্রযুক্তি ইলেকট্রনিক পণ্যের বর্জ্য (ই-বর্জ্য) তৈরি হচ্ছে একই সঙ্গে। ই-বর্জ্যের এক–তৃতীয়াংশ সৃষ্টি হচ্ছে মুঠোফোন থেকে।

ই-বর্জ্য নিয়ে ভাবা হচ্ছে না। ব্যবহারের পর যেখানে-সেখানে ই-বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এটি কত ভয়াবহ তা–ও অনেকে জানেন না। মানুষের মধ্যে ই-বর্জ্য নিয়ে কোনো সচেতনা নেই। ই-বর্জ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পুনঃপ্রক্রিয়া (রিসাইক্লিং) করে এসব ই-বর্জ্য অন্যভাবে ব্যবহার করতে হবে।

আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর একটি হোটেলে তথ্যপ্রযুক্তি সাংবাদিকদের সংগঠন বাংলাদেশ আইসিটি জর্নালিস্ট ফোরামের (বিআইজেএফ) আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘ই-বর্জ্যের কার্বন ঝুঁকিতে বাংলাদেশ: কারণ ও উত্তরণের পথ’ শীর্ষক আলোচনায় এমন আশঙ্কার কথা তুলে ধরেন বক্তারা।

সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বাংলাদেশ) নির্বাহী কমিটির সদস্য শাফকাত হায়দার বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন। বৈঠকে প্রধান অতিথি বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, ‘সরকার ই-বর্জ্য নিয়ে কাজ করছে। ই-বর্জ্যের সমস্যার মধ্যে কিছু সম্ভাবনাও রয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে।’

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের স্কুল অব সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডিন সৈয়দ আক্তার হোসেন। প্রবন্ধে তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালে বিশ্বে প্রথম ই-বর্জ্য তৈরি হয়, যা আজ পৃথিবীর জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার প্রযুক্তি ক্ষেত্র এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু ই-বর্জ্য অপসারণের কোনো পদক্ষেপ এখনো দেখা যাচ্ছে না। এ বিপর্যয় থেকে একার পক্ষে উঠে আসা সম্ভব নয়।

সৈয়দ আখতার হোসেন জানান, ‘স্মার্টফোন থেকে সবচেয়ে বেশি ই-বর্জ্য তৈরি হয়। ই-বর্জ্য ফেলে না দিয়ে রিসাইক্লিং করে আমরা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারব। তবে ই-বর্জ্যের ঝুঁকি সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। ই-বর্জ্য ব্যবহারের ফলে মানুষকে শারীরিকভাবে অনেক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ই-বর্জ্য নিয়ে নীতিমালা আছে। আামাদের দেশে আধুনিক একটি নীতিমালা করতে হবে।’

আলোচনায় র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘সরকারের আইন আছে, সে আইন না মানলে আমার ব্যবস্থা নেই। শুধু আইন প্রয়োগ করে যেকোনো কিছু পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে না পারলে ই-বর্জ্যের অপব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়।’

বৈঠকের শুরুতে বিআইজেএফের সভাপতি নাজনীন নাহার বেগম বলেন, ‘প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহার করে দেশকে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে, সেই পণ্যগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে কই যাচ্ছে তা কেউ দেখছে না। এসব ই-বর্জ্য যেন দেশের ক্ষতির কারণ না হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে।’

অনুষ্ঠানে আলোচনা করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের উপসচিব সাঈদ আলী, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের (ডিএনসিআরপি) উপপরিচালক (ঢাকা বিভাগ) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের স্পেকট্রাম বিভাগের উপপরিচালক মো. মাহফুজুল আলম, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল অনুষদের সিইআরএম পরিচালক রওশন মমতাজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস ও মেকাট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক লাফিফা জামাল।

এ ছাড়াও আলোচনায় অংশ নিয়ে ই-বর্জ্য নিয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সাবেক সভাপতি শাহীদ-উল মুনির, গ্লোবাল ব্র্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড চেয়ারম্যান আবদুল ফাত্তাহ, স্মার্ট টেকনোলজিস (বিডি) লিমিটেড ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম, জেআর রিসাইক্লিং বা সলিউশন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ হোসেন, এইচপি বাংলাদেশের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার (ভোক্তা পিএস) কৌশিক জানা, আসুস বাংলাদেশের কান্ট্রি প্রোডাক্ট ম্যানেজার আসাদুর রহমান, লেনোভো ভারতের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক ব্যবসা) সুমন রায় ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার নাজমুস সালেহীন।

আলোচনায় বক্তারা বলেন, আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে ই-বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৭ কোটি ৪৭ লাখ মেট্রিক টনে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে নগরায়ণে বাড়ছে ই-পণ্যের চাহিদা। এ ক্ষেত্রে ডিজিটাল থেকে স্মার্ট পথে যাত্রা করা বাংলাদেশেও এসব পণ্যের চাহিদা ব্যাপক। আর স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি নিয়েই উন্নত দেশের ব্যবহৃত তথ্যপ্রযুক্তি ও ইলেকট্রনিকস পণ্যের অবাধ আমদানি এবং তা যথাযথ প্রক্রিয়ায় ডাম্পিং না করায় ই-বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। প্রতিবছর দেশে সৃষ্টি হচ্ছে ৩০ লাখ মেট্রিক টন ই-বর্জ্য। এর মধ্যে কেবল মুঠোফোন থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে সর্বোচ্চ সাড়ে ১০ লাখ টন ই-বর্জ্য। অন্তত ২ লাখ ৯৬ হাজার ৩০২টি নষ্ট টেলিভিশন থেকে সৃষ্টি হচ্ছে ১ লাখ ৭০ হাজার টনের মতো ই-বর্জ্য।

আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এই বর্জ্যের পরিমাণ বেড়েছে ৩০ শতাংশ। সেই হিসাবে ২০২৫ সাল নাগাদ কোটি টনের ই-বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হবে বাংলাদেশ। কেননা, ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে ১০০ কোটি মুঠোফোন উৎপাদন হবে এবং কম্পিউটারের পিসিবিভিত্তিক ধাতু পুনরুদ্ধার ব্যবসা সম্প্রসারিত হবে, যা ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ মানবিক সংকট।

অনাহূত এই মানবিক সংকট মোকাবিলায় সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি ‘ই-বর্জ্য’ সৃষ্টিকারী রিফারবিশড (পুরোনো বা ফেলে দেওয়া পণ্য আবার ব্যবহার উপযোগী করা) পণ্যের অবৈধ আমদানি বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয় এ বৈঠকে। বক্তারা বলেন, ই-বর্জ্য ব্যক্তির স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি পরিবেশের ওপরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছে। যথাযথ ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় দূষিত করছে পানি, বায়ু ও মাটি। বাড়াচ্ছে পরিবেশের তাপমাত্রা এবং বিনষ্ট করছে জমির উর্বরতাও। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এখনই দেশের ‘ই-বর্জ্য’ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে স্মার্ট বাংলাদেশ।