বাংলাদেশের ই-কমার্স: কোথায় আছি, কোথায় যেতে চাই
পর্ব–১
একসময় বাংলাদেশের ব্যবসা মানেই ছিল দোকানপাট আর মেলায় বিকিকিনি। কিন্তু ডিজিটাল যুগের হাতছানিতে আজ সেই বাণিজ্য এসেছে মোবাইলের পর্দায়, ল্যাপটপের ক্লিকে। ই-কমার্স এখন আর বিলাসিতা নয়, এটি মানুষের নিত্যব্যবহার্য। দেশের তরুণ উদ্যোক্তারা এই পরিবর্তনের প্রধান চালিকা শক্তি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এত দূর এসেও আমরা কি যথেষ্ট প্রস্তুত? আমাদের বর্তমান অবস্থান কোথায়, আর সামনে যাওয়ার পথ কী?
বাংলাদেশে ই-কমার্সের অগ্রযাত্রা
বাংলাদেশে ই-কমার্সের সূচনা হয় মূলত ২০০৯-১০ সাল থেকে। প্রথম দিকে কিছু ওয়েবসাইট–নির্ভর ব্যবসা শুরু হলেও ফেসবুকের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম–নির্ভর ক্ষুদ্র ব্যবসার জোয়ার আসে। বর্তমানে প্রায় ২ লাখের বেশি ই-কমার্স উদ্যোগ সক্রিয়, যার মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি ফেসবুকভিত্তিক। (সূত্র: ই–ক্যাব অ্যানুয়াল রিপোর্ট ২০২৩)
মোবাইল আর্থিক সেবার ভূমিকা
ই-কমার্সের প্রসারে বিকাশ, নগদ, রকেটের মতো মোবাইল আর্থিক সেবার অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, প্রতিদিন গড়ে ৫–৬ লাখ অনলাইন লেনদেন হয়, যার অধিকাংশই ই-কমার্স সম্পর্কিত। এই প্রবাহ গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত ই-কমার্স বিস্তারের রাস্তা তৈরি করেছে।
কোভিড-১৯ এবং ই-কমার্স বিপ্লব
কোভিড-১৯ মহামারিকালে যখন মানুষ ঘরবন্দী ছিল, তখন ই-কমার্সই হয়ে ওঠে প্রধান কেনাকাটার মাধ্যম। খাদ্যপণ্য, ওষুধ, পোশাক, এমনকি গৃহস্থালিসামগ্রীর চাহিদা অনলাইনে দ্রুত বেড়ে যায়। লাইটক্যাসল পার্টনারসের গবেষণামতে, কোভিড–পূর্ব সময়ের তুলনায় ই-কমার্স লেনদেন তখন ৩০–৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
অর্জন এবং সম্ভাবনা
* কর্মসংস্থান: প্রায় ২০–২৫ লাখ মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ই-কমার্সের সঙ্গে যুক্ত। (ই–ক্যাব, ২০২৩)
* নারী ক্ষমতায়ন: ৫০ হাজারের বেশি নারী উদ্যোক্তা অনলাইন ব্যবসায় সক্রিয়।
* এসএমই অন্তর্ভুক্তি: প্রায় ৪০ শতাংশ ই-কমার্স উদ্যোগ এসএমই মালিকানাধীন।
* ফিনটেক বিস্তার: ৯৫ শতাংশ লেনদেন এখন ডিজিটাল মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। (বাংলাদেশ ব্যাংক রিপোর্ট ২০২৩)
* লজিস্টিকস উন্নয়ন: পেপারফ্লাই, রেডএক্স, পাঠাও কুরিয়ার সেবা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
মূল চ্যালেঞ্জ
* গ্রাহক আস্থা সংকট: অনিয়মিত পণ্য সরবরাহ, ভুয়া বিজ্ঞাপন ও টাকা ফেরত (রিফান্ড) জটিলতা এখনো বড় সমস্যা।
* ডিজিটাল নিরাপত্তাঝুঁকি: সাইবার নিরাপত্তার দুর্বলতার কারণে ব্যক্তিগত তথ্য চুরির ঝুঁকি রয়েছে।
* রেজিস্ট্রেশন ও করের জটিলতা: এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসায়িক লাইসেন্স ও ট্যাক্স রেজিম সহজ নয়।
* আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের বাধা: পেপ্যাল, স্ট্রাইপের মতো বৈশ্বিক লেনদেন অনুপস্থিতি।
* দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি: ই-কমার্স পরিচালন, ডিজিটাল বিপণন ও ডেটা অ্যানালিটিকসে দক্ষতা প্রয়োজন।
বিশ্ব অভিজ্ঞতা, কিছু উদাহরণ
চীন: আলিবাবা ও জেডডি ডটকমের নেতৃত্বে চীন এখন বিশ্বের বৃহত্তম ই-কমার্স বাজার।
ভারত: অ্যামাজন ও ফ্লিপকার্টের মাধ্যমে দ্রুত ই-কমার্স প্রবৃদ্ধি। সরকারের ওএনডিসি প্ল্যাটফর্ম চালু হয়েছে এমএসএমই সমর্থনে।
ভিয়েতনাম: দেশীয় লেনদেন গেটওয়ে ও জাতীয় ই-কমার্স কৌশল কার্যকর করে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন।
বাংলাদেশের সামনে রোডম্যাপ
* নীতিমালার সরলীকরণ ও ডিজিটাল ট্রেড লাইসেন্স চালু করা।
* ক্রস-বর্ডার ই-কমার্সের জন্য রপ্তানির নীতি সহজ করা।
* আন্তর্জাতিক লেনদেন গেটওয়ে ব্যবস্থার উন্নয়ন।
* উদ্যোক্তাদের জন্য বিনা মূল্যে বা স্বল্প খরচে ই-কমার্স প্রশিক্ষণ চালু করা।
* জাতীয় পর্যায়ে ই-কমার্স উন্নয়ন কাউন্সিল গঠন করা।
ভবিষ্যতের লক্ষ্য: ২০৩০–এর স্বপ্ন
* ই-কমার্সের মাধ্যমে দেড় হাজার কোটি ডলারের বাজার তৈরি করা।
* কমপক্ষে ১০ লাখ নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি।
* বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নতুন উৎস হিসেবে ক্রস-বর্ডার রপ্তানি বৃদ্ধি।
* প্রযুক্তি, দক্ষতা ও নীতিনির্ভর ই-কমার্স ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা।
বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত এখন এক পরিবর্তনের দোরগোড়ায়। কাজ শুরু হয়েছে, সফলতাও এসেছে। তবে সামনে যেতে হলে প্রয়োজন সুপরিকল্পিত রোডম্যাপ, সাহসী নেতৃত্ব এবং সবার অংশগ্রহণ। আমরা বিশ্বাস করি, উদ্যোক্তা, বাণিজ্য ও দেশের উন্নয়ন একসুতায় গাঁথতে হলে ই-কমার্স হবে প্রধান হাতিয়ার। এগিয়ে চলুক বাংলাদেশের ই-কমার্স, বিশ্বমঞ্চে নতুন ইতিহাস লিখুক।
(চলবে)
ড. মোহাম্মদ নূরুজ্জামান: গ্রুপ সিইও, ড্যাফোডিল ফ্যামিলি ও কোষাধ্যক্ষ, গ্লোবাল এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ