একে-৪৭ ও কালাশনিকভের অজানা ১০

পছন্দের আগ্নেয়াস্ত্র: আবু, সিয়েরা লিয়নের নয় বছর বয়সী যোদ্ধা তার প্রিয় একে-৪৭ রাইফেল ধরে আছে। ২০০০ সালে তোলা ছবি। রয়টার্স।
পছন্দের আগ্নেয়াস্ত্র: আবু, সিয়েরা লিয়নের নয় বছর বয়সী যোদ্ধা তার প্রিয় একে-৪৭ রাইফেল ধরে আছে। ২০০০ সালে তোলা ছবি। রয়টার্স।

যে হাতে কলমে লেখা হয়েছিল শান্তির কবিতা, সেই একই হাত তৈরি করেছিল বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র একে-৪৭। তিনি মিখাইল কালাশনিকভ। ২৩ ডিসেম্বর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন কালাশনিকভ অ্যাসল্ট রাইফেলের উদ্ভাবক মিখাইল কালাশনিকভ। ৯৪ বছর বয়সে রাশিয়ার উদমুরত প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ইজহভস্কে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন বিশ্বখ্যাত স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের এই নকশাবিদ।

চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে মিখাইল কালাশনিকভ কবি হতে চেয়েছিলেন। কিশোর বয়স থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন তিনি। রাইফেলের মতো আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করলেও আজীবন কবিতার সাধনা করেছেন কালাশনিকভ। ২০০৯ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ছাড়াও এখানে আরও খারাপ কবি আছেন। আমি একাই ভিন্ন পথে চলে গেছি।’

কালাশনিকভ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯১৯ সালের ১০ নভেম্বর, পশ্চিম সাইবেরিয়ায়। জন্মেছিলেন একেবারে সাধারণ কৃষক পরিবারে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই নিত্যনতুন উদ্ভাবনের দিকে ঝোঁক ছিল তাঁর। কিশোর বয়সেই প্রতিভার ছাপ রেখেছিলেন সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে। ট্যাংক থেকে গোলা নিক্ষেপের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে সেনাবাহিনীতে তরুণ উদ্ভাবকের স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন। ১৯৪১ সালে যুদ্ধে আহত হন তিনি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তিনি এমন একটি অটোমেটিক রাইফেলের নকশা করেছিলেন, যা সব পরিস্থিতিতে টেকসই হবে এবং আগ্নেয়াস্ত্র হিসেবে হবে বিধ্বংসী। প্রায় সাত বছরের পরিশ্রমে তিনি তৈরি করেন একে-৪৭। কালাশনিকভের সেই নকশা করা আগ্নেয়াস্ত্রটিই গত অর্ধশতাব্দীতে সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়ে আছে।

একে-৪৭ হাতে এর উদ্ভাবক মিখাইল কালাশনিকভ
একে-৪৭ হাতে এর উদ্ভাবক মিখাইল কালাশনিকভ

চল্লিশের দশকে সে সময়কার সোভিয়েত ইউনিয়নের নকশাবিদ মিখাইল কালাশনিকভের কাছ থেকে বিশ্ববাসী পেয়েছিল ধ্রুপদি নকশার সহজলভ্য, শক্তিশালী আর পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই মারাত্মক এ আগ্নেয়াস্ত্রটি। ধ্রুপদি নকশার জন্য লন্ডনের ডিজাইন মিউজিয়াম ২০১১ সালে যেসব পণ্য নির্বাচন করেছিল, তার একটি ছিল একে-৪৭।

কালাশনিকভ যে স্বয়ংক্রিয় রাইফেলটি উদ্ভাবন করেন, তা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যবহূত একটি আগ্নেয়াস্ত্র। তাঁর নামেই এটির নামকরণ হয়েছিল। এর নকশাও খুবই সাদামাটা আর এটি তৈরি করতে খরচও খুব কম। এ ছাড়া অস্ত্রটির রক্ষণাবেক্ষণও সহজ। বিশ্বে বর্তমানে ১০ কোটিরও বেশি কালাশনিকভ রাইফেল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এ রাইফেল আবিষ্কারের জন্য কালাশনিকভ তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে রায় সম্মান পান। কিন্তু এ থেকে তিনি আর্থিকভাবে খুব বেশি লাভবান হননি।

একে-৪৭-এর মতো ভয়ংকর অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে দেখে দুঃখ পেয়েছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার তৈরি অস্ত্র দিয়ে যখন সন্ত্রাসীদের গুলি চালাতে দেখি, তখন কষ্ট পাই।’

কালাশনিকভের ১০ অজানা

১. মোজাম্বিকের জাতীয় পতাকায় দেশটির সংগ্রাম ও স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে স্থান করে নিয়েছে কালাশনিকভ রাইফেল।

২. আফ্রিকার কয়েকটি দেশে কালাশনিকভ শব্দটির সংক্ষিপ্ত রূপ ‘কালাশ’ ছেলেদের নামের পরিচিতি হিসেবে ব্যবহূত হয়।

৩. একে-৪৭ রাইফেলটিতে মাত্র আটটি নড়াচড়া করানো সম্ভব এমন অংশ রয়েছে। এই রাইফেলটির অংশগুলো খুলে মাত্র ৩০ সেকেন্ডেই তা আবারও জোড়া লাগানো সম্ভব। অস্ত্রটি বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশেও ব্যবহার করা যায়।

৪. মিখাইল কালাশনিকভ কবি হতে চেয়েছিলেন। কিশোর বয়স থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন তিনি। রাইফেলের মতো আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করলেও আজীবন কবিতার সাধনা করেছেন তিনি। ২০০৯ সালে মিখাইল বলেছিলেন, ‘আমি ছাড়াও এখানে আরও খারাপ কবি আছেন। আমি একাই ভিন্ন পথে চলে গেছি।’

৫.নিজের উদ্ভাবন নিয়ে তাঁর যেমন গর্ব ছিল তেমনি কিছুটা আক্ষেপও ছিল। একবার তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ভাবন না করে যদি কৃষকদের কাজে লাগে এমন কোনো যন্ত্র উদ্ভাবন করতাম! 

৬. যে বিখ্যাত আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ভাবনে কালাশনিকভ বিখ্যাত হয়েছিলেন তা থেকে এক পয়সাও রোজগার হয়নি তাঁর। তবে পরবর্তী সময়ে তাঁর নামটিই ব্র্যান্ড হিসেবে বিখ্যাত হয়ে যায়। ভদকা, ছাতা ও ছুরির বিখ্যাত ব্র্যান্ড হয়ে ওঠে কালাশনিকভ।

৭. ইয়েমেনে ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়ায় প্রচলিত প্রথা হিসেবে কালাশনিকভের ব্যবহার দেখা যায়। সম্প্রতি ইয়েমেনে এক বিয়েবাড়িতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন বা চালকবিহীন বিমানের হামলার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে একে-৪৭ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিয়েছে দেশটির একটি সংগঠন।

৮. ২০০৪ সালে বিশ্বকে বদলে দিয়েছে এমন ৫০টি পণ্যের তালিকা প্রকাশ করেছিল প্লে বয় ম্যাগাজিন, যেখানে স্থান করে নিয়েছিল একে-৪৭। 

৯. একে-৪৭ নিয়ে বিখ্যাত হয়েছে অনেক গান। এর মধ্যে রয়েছে মার্কিন র্যাপ গায়ক লিল ওয়েনের একে-৪৭।

১০. ধ্রুপদি নকশার জন্য লন্ডনের ডিজাইন মিউজিয়াম ২০১১ সালে যেসব পণ্য নির্বাচন করেছিল তার একটি ছিল একে-৪৭। বিশ্বে বর্তমানে ১০ কোটিরও বেশি কালাশনিকভ রাইফেল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।