তথ্য অপব্যবহারে যুক্তরাজ্যে ফেসবুকের রেকর্ড জরিমানা

ফেসবুক
ফেসবুক

তথ্যের অপব্যবহার করায় যুক্তরাজ্যে তথ্য সংস্থা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুককে প্রায় ৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। যুক্তরাজ্যে ফেসবুকের এটাই সবচেয়ে বড় জরিমানা। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত থাকায় ফেসবুককে এ জরিমানা দিতে হবে।

যুক্তরাজ্যের তথ্য কমিশনার অফিস (আইসিও) বলছে, যুক্তরাজ্যের নির্বাচনী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ফেসবুক থেকে ব্যবহারকারীর যেসব তথ্য নিয়েছিল, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তা পুরোপুরি মুছে ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে।

কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার বিলুপ্ত অভিভাবক প্রতিষ্ঠান এসসিএল ইলেকশনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করেছে। এ ছাড়া ‘তথ্য দালালদের’ কাছ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যক্তিগত তথ্য কেনার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইসিও।

জরিমানা বিষয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ শিগগিরই প্রতিক্রিয়া জানানোর কথা বলেছে।

আইসিও বলেছে, এগ্রিগেট আইকিউ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ বন্ধ করতে হবে।

রাজনৈতিক প্রচারকেরা ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করছে—এমন উদ্বেগের পর তদন্ত শুরু করে আইসিও। প্রায় ১৬ মাস তদন্তের পর ফেসবুকের বিরুদ্ধে জরিমানা করার পদক্ষেপ নিল সংস্থাটি।

এর মধ্যেই অবশ্য কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার সাবেক কর্মী ক্রিস্টোফার উইলি বোমা ফাটানো একটি তথ্য ফাঁস করেন। তিনি বলেন, লন্ডনভিত্তিক রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি ফেসবুক থেকে অনৈতিকভাবে লাখো তথ্য সংগ্রহ করে ব্যবহার করছে।

আইসিও তাদের তদন্তে দেখতে পায়, ফেসবুক নিজস্ব নিয়মনীতি ভেঙেছে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ফেসবুক ব্যবহারকারীর যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছে, তা মুছে ফেলেছে কি না, তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা দাবি করে, ফেসবুকের অনুরোধের পর ২০১৫ সালেই তারা সব তথ্য মুছে ফেলে। তবে আইসিও বলছে, ফেসবুক থেকে সংগৃহীত তথ্যের কপি অন্যদের সঙ্গে বিনিময় করা হয়েছে—এমন প্রমাণ তারা পেয়েছে।

আইসিওর একজন মুখপাত্র বলেন, ‘ফেসবুকের তথ্য মুছে ফেলার সনদের যথার্থতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।’

আইসিওর প্রতিবেদন বিষয়ে উইলি বলেন, ‘কয়েক মাস আগেই ফেসবুক ও কেমব্রিজ অ্যানলিটিকার কার্যক্রম সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের কর্তৃপক্ষকে আমি জানিয়েছিলাম। ওই অভিযোগের ভিত্তিতেই ফেসবুককে আজ রেকর্ড জরিমানা দিতে হচ্ছে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ও এর পরিচালকদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।’

কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি কী?
কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সহযোগিতার জন্য বেশি পরিচিত। ট্রাম্পের বিজয়ে এর ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি দাবি করছে, ফেসবুক থেকে সংগৃহীত কোনো তথ্য ট্রাম্পের প্রচারণার তারা ব্যবহার করেনি।

ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তথ্য বেহাত হওয়ার ঘটনাটি সামনে নিয়ে আসেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার সাবেক কর্মী ক্রিস্টোফার উইলি। তিনিই প্রথম জানান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবং যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছেদ) প্রশ্নে গণভোটে ভূমিকা ছিল তাঁর সাবেক কর্মস্থলের। এ ব্যাপারে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে সহযোগিতা করেছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক আলেকসান্দ্র কোগান। তিনি বিশেষ অ্যাপ তৈরি করে ফেসবুকের প্ল্যাটফর্মে ছেড়েছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে দিয়েছিলেন কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কাছে।

ক্রিস্টোফার উইলির ভাষ্যমতে, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ওই তথ্যগুলো প্রক্রিয়াজাত করে ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচার শিবিরকে সরবরাহ করেছিল। শুধু তা-ই নয়, ওই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য রিপাবলিকান ভোটারও চিহ্নিত করা হয়।

প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, সম্ভবত পাঁচ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। তবে পরে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে, ৮ কোটি ৭০ লাখ ব্যবহারকারীর তথ্য বেহাত হয়েছে।

পরে বিষয়টি নিয়ে মার্কিন সিনেটের শুনানিতে হাজির হতে হয় ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গকে। ওই শুনানিতে কয়েকবার মাফ চাওয়ার পাশাপাশি প্রাইভেসি পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতিও দেন জাকারবার্গ।

শুনানিতে জাকারবার্গ বলেন, ‘আমি ফেসবুক শুরু করেছিলাম এবং এর সবকিছুর জন্য আমি দায়ী।’

বিশ্লেষকেরা বলছেন, আইনপ্রণেতাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছেন যে ফেসবুকের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হতে পারে।

ফেসবুকের এই কেলেঙ্কারিতে সরব হন সরকার ও রাজনীতির বাঘা বাঘা ব্যক্তি। বিবিসি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এ ঘটনাকে ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ বলে অভিহিত করেন। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার লন্ডন কার্যালয়ে তল্লাশি চালানোর অনুমতি দেয় দেশটির তথ্য সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ।

বিশ্বজুড়ে ফেসবুক ও কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ঘিরে তদন্তের দাবি ওঠে। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরপরই কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা তাদের নির্বাহী আলেকজান্ডার নিক্সকে বরখাস্ত করে। রাজনীতিবিদদের ফাঁসাতে ঘুষ দেওয়া, যৌনকর্মী ব্যবহারসহ কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার গোপন কৌশল ছদ্মবেশী সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করেন তিনি। পরে সে তথ্য জনসমক্ষে চলে আসে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার পক্ষ থেকে অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়।

এ ঘটনার জের ধরে গত মে মাসে বন্ধ হয়ে যায় কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। গত মার্চ মাসে ‘ফেসবুক কেলেঙ্কারির’ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকেই চাপে পড়েছিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্বজুড়ে কঠোর সমালোচনা ছাড়াও কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে কয়েকটি দেশ।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, এনডিটিভি, ওয়াশিংটন পোস্ট।