আইফোনের নকশাকার

জনি আইভকে ‘স্পিরিচুয়াল পার্টনার’ মানতেন স্টিভ জবস
জনি আইভকে ‘স্পিরিচুয়াল পার্টনার’ মানতেন স্টিভ জবস

কোনো প্রশ্ন করা হলে জোনাথন আইভ খানিকক্ষণ সময় নেন। কী যেন ভাবেন। একা একা মাথা নাড়েন। তাঁর মস্তিষ্কের কোষগুলো যেন ছুটোছুটি করে একটা উত্তরের নকশা বানাতে। সেটাও হওয়া চাই নিখুঁত, নিখাদ এবং অনন্য। সে তো হবেই। যিনি আইফোন, আইপ্যাড, আইম্যাক, ম্যাকবুক এয়ার, আইপড, অ্যাপল ওয়াচের মতো অনন্য সব গ্যাজেটের নকশার দায়িত্বে ছিলেন, তাঁর সবকিছু তো অনন্য হবেই।

আইভের পুরো নাম স্যার জোনাথন পল আইভ। অ্যাপল ইনকরপোরেটেডের প্রধান ডিজাইন কর্মকর্তা। তাঁর কাজ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে। সেখানে লেখা, ‘যেকোনো যন্ত্রের আদল, সফটওয়্যারের ইউজার ইন্টারফেস, পণ্যের মোড়ক, অ্যাপল পার্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা দোকানগুলো—অ্যাপলে সব ধরনের নকশার দায়িত্বে জোনাথন আইভ। নতুন ধারণা এবং যেকোনো ভবিষ্যৎ উদ্যোগের দায়িত্বও তাঁর কাঁধে।’

টিম কুকের সঙ্গে জনি আইভ
টিম কুকের সঙ্গে জনি আইভ

পর্দার সামনে স্টিভ, পেছনে আইভ

১৯৯৭ সালে অ্যাপলে ফিরে সহ–প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্টিভ জবস যে কজন নির্ভরযোগ্য সহযোগীকে পেয়েছিলেন, জনি আইভ তাঁদের অন্যতম। স্টিভ যে স্বপ্ন দেখেছেন, বাস্তবায়ন করেছেন তিনি। জনি আইভকে ‘স্পিরিচুয়াল পার্টনার’ মানতেন স্টিভ। শিল্পের প্রতি তাঁদের আবেগ ও দর্শনে কোথাও কোনো কাটাকাটি ছিল না। হয়তো সে কারণেই অ্যাপলে ফিরেই জনিকে ‘সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন’ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সে থেকেই অ্যাপলের নকশাকার দলের নেতৃত্বে জনি।

জ্যেষ্ঠ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে জনি আইভের প্রথম কাজ ছিল আইম্যাকের নকশা করা। ঈষৎ স্বচ্ছ রঙিন প্লাস্টিকের মোড়কে তৈরি সেই অল-ইন-ওয়ান ডেস্কটপ কম্পিউটার নিয়ে মঞ্চে এলেন স্টিভ—অ্যাপলের পুনর্জন্ম হয়েছিল সেদিন। সেই আইম্যাকই অ্যাপলকে বাঁচিয়েছিল। এরপর একে একে আসে আইপড, আইফোন, আইপ্যাড। পর্দার সামনে আসতেন স্টিভ, পেছনে কাজ করে গেছেন আইভ। যেকোনো বস্তু দেখলে তাঁরা দুজন একই ধারণা পোষণ করতেন, একই প্রশ্ন করতেন। শুধু এক জায়গায় স্টিভ ছিলেন অনন্য। শিল্পবোদ্ধার পাশাপাশি তিনি ব্যবসায়-বোদ্ধাও ছিলেন। বিপণন ভালো বুঝতেন। এই কাজটা আইভ কোনো দিনই ঠিকভাবে ধরতে পারেননি। আর সে কারণেই জনি আইভের বদলে টিম কুককে রাজ্য সামলানোর দায়িত্ব দেন স্টিভ, মানে প্রধান নির্বাহীর পদে বসিয়েছিলেন।

জনির নকশায় তৈরি আইম্যাকে অ্যাপলের পুনর্জন্ম হয়েছিল
জনির নকশায় তৈরি আইম্যাকে অ্যাপলের পুনর্জন্ম হয়েছিল

টিম কুককে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠান বানালেন

অ্যাপলে জনি আইভের ক্ষমতা একটুও কমেনি কখনো। আগে দুজন মানুষ অ্যাপল চালাতেন। সেখানে যুক্ত হলেন টিম কুক। টিম ও জনির হাতে অ্যাপলের দায়িত্ব ছেড়ে নির্ভার হয়েছিলেন স্টিভ জবস। ২০১১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর সফটওয়্যারের ইউজার ইন্টারফেস নকশার দায়িত্বও নেন জনি আইভ। ২০১৩ সালে তাঁর পদবি বদলে হয় সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অব ডিজাইন। ২০১৫ সালে তা আবার বদলে করা হয় চিফ ডিজাইন অফিসার। স্টিভের মৃত্যুর পর আইভের নকশায় প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হলো অ্যাপল ওয়াচ।

অ্যাপলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন স্টুডিও নামে একটা অংশ আছে। জনি আইভের নেতৃত্বে সেখানে কাজ করেন একদল সৃজনশীল পেশাজীবী। অ্যাপলের বেশির ভাগ পণ্যের শুরু হয় ওই স্টুডিও থেকেই। সেখানে নকশা দল ও সি-লেভেল নির্বাহী ছাড়া কারও প্রবেশের অনুমতি নেই। এমনকি জনি আইভের সন্তান ও পরিবারের সদস্যরাও সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পান না। এর একটা কারণ হলো নতুন ধারণা ও পণ্যের প্রোটোটাইপ থাকে সে কক্ষে। আরেকটা কারণ, কাজটা তাঁরা একাগ্রচিত্তে করতে চান, কোনো উটকো ঝামেলা পছন্দ করেন না।

 যেভাবে এল আইফোন

অনেকে এখন ফোড়ন কেটে বলেন, শুরুতে মোবাইল ফোন ছিল ইটের মতো। ঠিক ইটের মতো না হলেও গাবদা-গোবদা তো ছিলই। সেখান থেকে হালকা-পাতলা গড়নের বড় (সে সময় মুঠোফোনে সাড়ে তিন ইঞ্চি পর্দা বড়ই ছিল) স্পর্শকাতর পর্দার আইফোন বানালেন জনি আইভ। পুরোনো কথা মনে করে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, কয়েক বছর ধরে আমরা প্রকল্পটি নিয়ে কাজ করেছি। শুরুতে কোনো ধারণা ছিল না, শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে। তবে মাল্টি টাচ বিষয়টি মাথায় ছিল। তখন মুঠোফোনের ওপরের দিকে পর্দা আর নিচের দিকে খুদে খুদে বোতাম থাকত। বোতামও ঠিকঠাক ব্যবহার করা যেত না, পর্দাও ছোট রাখতে হয়েছিল। আমরা ফিজিক্যাল বোতামের বদলে ভার্চ্যুয়াল বোতাম যোগ করলাম। মানে অ্যাপের প্রয়োজন অনুযায়ী বদলাবে বোতামের আকার। এতে পুরোটা জুড়ে পর্দা দেওয়া সম্ভব হলো।

একনজরে
১৯৬৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের লন্ডনে জোনাথন পল আইভের জন্ম। সেখানেই বেড়ে উঠেছেন। ইউনিভার্সিটি অব নর্থামব্রিয়ায় নকশা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। স্নাতক শেষে ট্যানজারিন নামের এক ডিজাইন ফার্মে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৯২ সালে কাজ শুরু করেন অ্যাপলে এবং ১৯৯৭ সাল থেকে নকশা দলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। নকশার জন্য পুরো ক্যারিয়ারে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। নকশা ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ব্রিটিশ রাজপরিবারের নাইট কমান্ডার অব দ্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার পদক পান। ২০১৭ সালের ২৫ মে তাঁকে লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব আর্টের আচার্য ঘোষণা করা হয়।