ডিজিটাল দুনিয়ার কণ্ঠস্বর

আইস বাকেট চ্যালেঞ্জে বিল গেটস
আইস বাকেট চ্যালেঞ্জে বিল গেটস

#CupforBen, একটি বিখ্যাত হ্যাশট্যাগ। বেন হলো ১৪ বছর বয়সী এক অটিস্টিক কিশোরের নাম। বেন ২ বছর বয়স থেকে পানি খাওয়ার জন্য দুই হাতলওয়ালা একধরনের কাপ ব্যবহার করে। একটা কাপ নষ্ট হলে বেনের বাবা মার্ক কার্টার একই রকমের আরেকটি কাপ কিনে আনেন। একসময় কোম্পানিটি ওই ধরনের কাপ উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। মার্ক কার্টার কোথাও কাপ খুঁজে না পেয়ে ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর একটা টুইট করলেন, কারও কাছে ওই কাপ আছে কি না। হ্যাশট্যাগ দিলেন #CupforBen। বেনের বাবা এটাও লিখলেন যে তাঁর ছেলে ওই কাপ ছাড়া পানি না খাওয়ায় এর আগে তাকে দু–একবার শরীরে পানিশূন্যতার জন্য হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত করতে হয়েছিল। এই টুইটের পরের ঘটনা ইতিহাস। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে হ্যাশট্যাগটা ভাইরাল হলো। কাপ প্রস্তুতকারী কোম্পানির চোখেও পড়ল হ্যাশট্যাগটি। তারা বেনের জন্য যত দিন দরকার হবে ওই কাপ সরবরাহের নিশ্চয়তা দিয়েছে। কারণ তারা বুঝতে পেরেছে, এটা শুধু একটা কাপ নয়, এটা বেনের জন্য জীবন।

এ সময়ের তুমুল আলোচিত হ্যাশট্যাগ মি টু
এ সময়ের তুমুল আলোচিত হ্যাশট্যাগ মি টু

প্রতিটি হ্যাশট্যাগের পেছনে এ রকম একটা করে গল্প আছে। আর প্রতিটি জনপ্রিয় হ্যাশট্যাগের পেছনে আছে একটি বড় গল্প। কিছু কিছু হ্যাশট্যাগ আছে, যার সঙ্গে অনেক নামীদামি মানুষ যুক্ত হন। এমন একটি হ্যাশট্যাগ হলো #IceBucketChallenge। এই হ্যাশট্যাগের চ্যালেঞ্জটি হলো এক বালতি বরফপানি মাথায় ঢালার ভিডিও করা কিংবা ছবি তোলা এবং এ সময়ে অন্য একজন কিংবা একাধিক জনকে একই কাজ করার জন্য চ্যালেঞ্জ করা। বিল গেটস, জর্জ বুশ, মার্ক জাকারবার্গসহ অনেক বিখ্যাত মানুষ এই হ্যাশট্যাগের চ্যালেঞ্জে অংশ নেন। বিল গেটসের ভিডিওতে দেখা যায়, নিজেই ধাতব কাঠামো বানিয়ে বালতি থেকে মাথায় বরফপানি ঢেলে তাঁর পছন্দের তিনজনকে একই চ্যালেঞ্জ দিতে। এই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা হয়েছিল মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের কোষ শুকিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত জটিল রোগ এএলএস সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি ও অর্থ সংগ্রহের জন্য। বিশ্বে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ এই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছিল এবং মাত্র এক মাসের মধ্যে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৮৫০ কোটি টাকারও বেশি উঠেছিল। উল্লেখ্য, এর আয়োজক এএলএস চ্যারিটি ফাউন্ডেশন ২০১৩ সালে তহবিল সংগ্রহ অভিযানে এক সপ্তাহে সংগ্রহ করতে পেরেছিল মাত্র ১০ লাখ টাকা। শুধুই একটি হ্যাশট্যাগ আন্দোলন তাদের বিপুল সাফল্য এনে দেয়।

হ্যাশট্যাগের এতটাই সামাজিক শক্তি। আর যে কারণে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক উদ্দেশ্য অর্জনে সারা বিশ্বে এখন হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করতে দেখা যায়। #metoo তেমনি একটি হ্যাশট্যাগ, যেখানে নারী নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরে নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের জনপ্রিয় হ্যাশট্যাগের তালিকায় প্রথম ২০টির মধ্যে #metoo রয়েছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি রয়েছে এক নম্বরে।

কিশোর বেনকে বাাঁচাতে কাপ ফর বেন হ্যাশট্যাগ
কিশোর বেনকে বাাঁচাতে কাপ ফর বেন হ্যাশট্যাগ

হ্যাশট্যাগের ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ে সবচেয়ে বেশিবার ব্যবহারের ইতিহাস হলো BringBackOurGirls হ্যাশট্যাগটির। ২০১৪ সালে নাইজেরিয়ায় সন্ত্রাসী দল বোকো হারাম ২৭৬টি মেয়েকে অপহরণ করলে তাদের উদ্ধারে আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে চালুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ১৩০ কোটি বারের বেশি টুইট হয়েছিল।

কোনো ধরনের দ্বিধা ছাড়াই বলা যায়, ডিজিটাল দুনিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী ও বহুল ব্যবহৃত চিহ্ন এখন হ্যাশট্যাগ (#)। টুইটার, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, ইউটিউব কিংবা অন্য কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন কিন্তু একবারও হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেননি এমন কাউকে এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ২০১৭ সালের এক হিসাবে বলা হয়েছে, প্রতিদিন সাড়ে ১২ কোটির বেশি হ্যাশট্যাগ ব্যবহৃত হয়েছে।

একই বিষয় নিয়ে কথা বলা মানুষদের একত্র করে একটি আলোচনার জায়গায় আনতে ইন্টারনেটে, ওয়েবে প্রথম হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা হয় ১৯৮৮ সালে ইন্টারনেট রিলে চ্যাটে (আইআরসি)। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ক্ষেত্রে প্রথম হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা হয় টুইটারে। প্রযুক্তিবিদ ক্রিস মেসিনা ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট টুইটারে যে হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেন, সেখানে তিনি লেখেন: “how do you feel about using # (pound) for groups. As in #barcamp [msg]?” আর জনসাধারণের জন্য টুইটার হ্যাশট্যাগ ব্যবহার উন্মুক্ত করে ২০০৯ সালে। হ্যাশট্যাগ চালু হওয়ার ফলে মানুষ সুযোগ পেল কোনো একটি ক্লাসিফায়েড বা শ্রেণিভুক্ত বিষয় নিয়ে কথা বলার। প্রথম ভাইরাল হওয়া হ্যাশট্যাগ হলো #FF (Follow Friday)।

বেশিবার ব্যবহার হওয়া হ্যাশট্যাগ দেখাচ্ছেন সালমা হায়েক
বেশিবার ব্যবহার হওয়া হ্যাশট্যাগ দেখাচ্ছেন সালমা হায়েক

ফেসবুকে হ্যাশট্যাগ চালু হলো ২০১৩ সালে। এরপরই এটি লিঙ্কড–ইনে চালু হয়। তারপর একে একে বাকি সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। জনপ্রিয় হ্যাশট্যাগ খোঁজার জন্য আলাদা ওয়েবসাইট আছে, যেমন হ্যাশট্যাগস ডট ওআরজি (Hashtags.org)। হ্যাশট্যাগ শুধু লেখার শেষে নয়, লেখার মধ্যে যেকোনো জায়গায় ব্যবহার করা যায়। হ্যাশট্যাগে ক্লিক করলে যতজন এযাবৎকালে ওই নির্দিষ্ট হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেছেন তাঁদের সবার লেখা দেখাবে।

হ্যাশট্যাগ ব্যবহারের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে একই বিষয় নিয়ে অনেকের বলা কথাগুলো একসঙ্গে দেখার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। হ্যাশট্যাগ বসিয়ে লাখো–কোটি আলোচনার মধ্য থেকে একই ধরনের আলোচনাগুলোকে শ্রেণিভুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। হ্যাশট্যাগ চালু হওয়ার পর বিষয়কেন্দ্রিক সামাজিক যোগাযোগ যেমন সহজ হয়েছে, নির্দিষ্ট ধরনের পণ্য ও সেবার বিপণনও বেগবান হয়েছে। পণ্য কিংবা কোম্পানির ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরিতে এবং প্রতিযোগীদের চেয়ে এগিয়ে রাখতে হ্যাশট্যাগ এখন খুবই ব্যবহৃত একটি উপায়। তাই হ্যাশট্যাগ শুধু সামাজিক যোগাযোগ আর আন্দোলনের মাধ্যম নয় হ্যাশট্যাগ একই সঙ্গে ব্যবসার ব্র্যান্ড তৈরি ও ব্যবসা প্রসারেরও মাধ্যম।

প্রথম ভাইরাল হয় ফলো ফ্রাইডে হ্যাশট্যাগ
প্রথম ভাইরাল হয় ফলো ফ্রাইডে হ্যাশট্যাগ

রাজনীতিতে হ্যাশট্যাগ খুব ব্যবহার করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে বারাক ওবামা সম্ভবত প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি টুইটারের শক্তি বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি ৭৫০ জনেরও বেশি কমিউনিটি ম্যানেজারকে নিয়োগ দিয়েছিলেন যাঁদের কাজ ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ইমেজ বাড়ানো। এখন তো রাজনীতিতে হ্যাশট্যাগ ব্যবহার না করলে একজন রাজনীতিক কয়েক কোটি ডিজিটাল বাসিন্দার কাছে পৌঁছানোর সহজ পথটা হারাবে।

একজন ব্যবহারকারী তাঁর ইচ্ছেমতো শব্দ হ্যাশট্যাগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন যদি সেটা নির্দিষ্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিয়মের পরিপন্থী না হয়। সাধারণ আক্রমণাত্মক শব্দ বা শব্দগুচ্ছ, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নামে কোনো কিছু করা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষিদ্ধ। হ্যাশট্যাগের অক্ষর ও শব্দসংখ্যা কম রাখা ভালো। বিষয়ের সঙ্গে মিল রাখাটাই দরকার, যাতে করে তিনি যাঁদের এই গ্রুপে যুক্ত করতে চান তাঁরা সহজেই বুঝতে পারেন। সঠিকভাবে হ্যাশট্যাগ নির্বাচন করা সম্ভব হলে যে উদ্দেশ্যে হ্যাশট্যাগ তৈরি করা, সেই উদ্দেশ্য সফল হয়। কয়েকটি জনপ্রিয় হ্যাশট্যাগ ব্যবহারের কথা ভাবতে পারেন। যেমন সামাজিক পরিবর্তন ও অ্যাক্টিভিজমের জন্য: #socialgood, #socialchange, #cause, #volunteer; অলাভজনক ও ফাউন্ডেশনের জন্য: #nonprofit, #philanthropy; সামাজিক ব্যবসার জন্য: #socent, #impinv, #crowdfunding, #socialbusiness, #changemakers, #BOP; সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও পরিবেশের জন্য: #humanrights, #poverty, #sustainability, #climate, #eco ইত্যাদি।

হ্যাশট্যাগ আন্দোলন বাস্তবে কতটা কার্যকর তা নিয়ে অনেক ধরনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক কথা আছে। সমালোচকদের কথামতো হ্যাশট্যাগে সত্যিকারের পরিবর্তন কতটা ঘটে, তা নিয়ে মতবিরোধ থাকতেই পারে। কিন্তু এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে খুব অল্প সময়ে বিশ্বের সর্বাধিক সংখ্যক মানুষকে কোনো একটি ইস্যুতে একত্র করার ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত হ্যাশট্যাগের বিকল্প কিছু বের হয়নি।
লেখক: উন্নয়ন কর্মী ও লেখক

#
হ্যাশট্যাগ হলো একধরনের মেটাডেটা ট্যাগ, যা টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকসহ অন্যান্য বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই ট্যাগগুলো ব্যবহারকারীরা নিজেরাই তৈরি করে থাকেন এবং এই ট্যাগযুক্ত সব লেখা বা পোস্ট, ছবি, ভিডিও একত্রে খুঁজে পাওয়া ও প্রদর্শনের জন্য ব্যবহার করা হয়। # চিহ্নটি যুক্তরাষ্ট্রে পাউন্ড চিহ্ন হিসেবে পরিচিত ছিল এবং সংখ্যা বোঝাতে এটি ব্যবহৃত হতো। অপর দিকে যুক্তরাজ্যে পাউন্ড চিহ্ন বলতে ‘£’ এবং ‘#’ চিহ্নটিকে বলা হতো হ্যাশ। কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের বিভিন্ন ভাষায় এই চিহ্নটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে আসছ। ১৯৭০–এর সময় থেকে পিডিপি-১১ মিনি কম্পিউটারের অ্যাসেমব্লি প্রোগ্রামিং ভাষা, ১৯৭৮ সালে তৈরি করা সি-প্রোগ্রামিং ভাষায়ও # ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমানে হ্যাশট্যাগের সর্বাধিক ব্যবহার দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ক্রিস মেসিনা প্রথম টুইটারে এর প্রস্তাব করেন। টুইটারে এই বৈশিষ্ট্যটি চালু করার পরপরই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং ধীরে ধীরে অন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোও এটি ব্যবহার শুরু করতে থাকে। যদিও ১৯৮৮ সালে দিক থেকেই # চিহ্নটি আইআরসি চ্যাটিং মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। হ্যাশট্যাগ লেখার সর্বজনীন কোনো নীতিমালা না থাকলেও প্রায় সব জায়গাতেই হ্যাশট্যাগগুলো # চিহ্ন দিয়ে শুরু হয় এবং এরপর কোনো স্পেস ছাড়া একসঙ্গে এক বা একাধিক শব্দ বা বাক্যাংশ লেখা হয়ে থাকে। ইংরেজিতে লেখার সময় বড় হাতের ও ছোট হাতের অক্ষর মিলিয়ে লেখা হয় সাধারণত হ্যাশট্যাগটি পড়ার সুবিধার জন্য কিন্তু কারিগরি দিক থেকে “#hashtag” এবং “#HashTag” একই অর্থ বহন করে।
নাসির খান