এইসব ডিজিটাল দিনরাত্রি

>

মডেল: লিমন, আয়োনা ও লোপা, ছবি: কবির হোসেন
মডেল: লিমন, আয়োনা ও লোপা, ছবি: কবির হোসেন

এমন কিছু প্রযুক্তিযন্ত্র আছে, যেগুলো পরিবারের সবাই ব্যবহার করতে পারে। আবার একেক সদস্যের জন্য একেক প্রযুক্তিরও প্রয়োজন পড়ে। কাজ, বিনোদন কিংবা যোগাযোগের জন্যই এসব দরকার এ যুগে। প্রযুক্তি ও যন্ত্রের নিরাপদ ও কার্যকর ব্যবহার কীভাবে করা যায়, তা থাকছে এবারের প্রতিবেদনে।

ঢাকারর মোহাম্মদপুরে ভাড়া করা একটি ফ্ল্যাটে তাঁরা থাকেন। তারিক জোয়ারদার প্রশাসনিক পদে ভালো চাকরি করেন। স্ত্রী ফাতিমা ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেছেন। বাসায় থাকেন। নিয়ম দিয়ে ধরে বেঁধে রাখে, এমন কাজ তিনি পছন্দ করেন না। তাই চাকরি করা হয়নি। ৯ বছর বয়সের মেয়ে ও ১৪ বছরের ছেলে—এ নিয়েই পুরো পরিবার।

পরিবারের সবার নিজ নিজ মোবাইল ফোন আছে। এমনকি নয় বছরের সন্তানের হাতেও। স্কুলে দেওয়ার শুরু থেকেই সন্তানের হাতে মোবাইল দিয়ে বাবা–মা দুজনই স্বস্তি বোধ করেছেন, মনে করেছেন, সব সময় সবাই খুব কাছে। পরিবারের সবার নম্বর একই অপারেটরের। সবার ফোনের বিল তারিক জোয়ারদার অনলাইনে পরিশোধ করে থাকেন। মোবাইল সেবাদাতার অ্যাপ নামিয়ে রেখেছেন, সন্তানদের ফোনের দেখাশোনা ওই অ্যাপ দিয়ে করে নেন। তারিক জোয়ারদার নিজে দুটি ফোন ব্যবহার করেন, অফিস থেকে দিয়েছে একটি অ্যান্ড্রয়েড ফোন আর নিজেরটা আইফোন। নিজের নম্বর কখনো হাতছাড়া হতে দেননি। গুগল অ্যাকাউন্ট খোলার সময় যখন ফোন ভেরিফিকেশন চেয়েছিল, তখন নিজেরটা দিয়েছিলেন, অফিসের নম্বর দেননি। তারিক জোয়ারদার এটা বুঝেছিলেন যে নিজের ই–মেইল আইডিটাই হবে তাঁর সারা জীবনের পরিচয়। যেন স্থায়ী বাড়ির হোল্ডিং নম্বর। যদিও ছেলেমেয়ের ই–মেইল আইডি তৈরি করে দিয়েছেন তাদের নিজ নিজ ফোন নম্বর দিয়ে। নিরাপত্তার জন্য যখন দ্বিতীয় একটি নম্বর লাগল, তখন পরিবারের প্রধান হিসেবে নিজেরটাই দিয়েছেন। কোনো কারণে তাদের ই–মেইল পুনরুদ্ধারের প্রয়োজন হলে তার স্থায়ী নম্বরটি কাজে লাগবে।

জীবন আনন্দময়, সহজ করে দিতে পাের প্রযুক্তি
জীবন আনন্দময়, সহজ করে দিতে পাের প্রযুক্তি

দ্বিতীয় সন্তান তাবাসসুম জন্ম নেওয়ার পরপরই তার পুরো নাম দিয়ে একটি ডোমেইন নিবন্ধন করে রেখেছিলেন। ভেবেছেন, ডটকম দিয়ে ইন্টারনেটে ছেলেমেয়ের নামে ঠিকানা থাকলে ভবিষ্যতে ওদের অনেক কাজে লাগবে। যদিও তারিক জোয়ারদার নিজে খুব একটা ‘ডিজিটাল ব্যক্তি’ না, তবু সন্তানদের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যায়, তা তো বলা যায় না।

তাবাসসুমের স্কুলে বাসা থেকে পাঁচ মিনিটেই হেঁটে যাওয়া যায়। এই বাসা নেওয়ার সময় তারিক জোয়ারদার অন্য সবকিছুর সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগটা কেমন আছে, তা যাচাই করে নিয়েছিলেন। স্থানীয় সংযোগদাতার সঙ্গে কথা বলে ভালো মনে হলেও অতিরিক্ত ব্যবস্থা হিসেবে রাউটারের সঙ্গে মোবাইল ইন্টারনেটের সিম লাগিয়ে নিয়েছিলেন। খরচ বলতে তো শুধু একটি সিমের দাম। ওই সিমে ইন্টারনেট প্যাকেজ দরকার মতো চালু করে নেওয়া যায়। মূল ইন্টারনেট সংযোগের তার কাটা গেলেও এভাবে নেট চালু রাখতে পারেন। পরিবারের সবাই রাউটারের ওয়াই–ফাই সংযোগ ব্যবহার করেন। বাসায় অতিথি এলে অনেক সময় ওয়াই–ফাই পাসওয়ার্ড দিতে হয়। এতে পাসওয়ার্ডের গোপনীয়তা বারবার নষ্ট হয়ে যায়। এবার একটি চার অ্যান্টেনার নতুন রাউটার লাগিয়েছেন, এখন সাময়িক প্রয়োজনে মূল পাসওয়ার্ড আর দিতে হয় না। এই রাউটার ছুঁলেই সেই মুহূর্তে কার্যকরী যন্ত্রগুলোতে একবার ব্যবহার করা যায়, এমন পাসওয়ার্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় হয়ে যায়। ব্যবহারকারী যখন রাউটারের সীমানার বাইরে একবার চলে যান, তখন থেকে পাসওয়ার্ডটি আর কাজ করে না।

তারিক জোয়ারদার সাড়ে ১৩ ইঞ্চি পর্দার ল্যাপটপ ব্যবহার করেন, অ্যাপল মেকবুক প্রো। স্ত্রী ও ছেলে এইচপি প্রোবুক। মেয়ের পছন্দ গোলাপি রঙের লেনোভো। বিভিন্ন সময় ঢাকা থেকেই কেনা এগুলো। অফিসের নোটবুক বাসায় আনেন না। সব কাজ গুগল ড্রাইভে রেখে কাজ করেন। বাসা থেকে যেকোনো সময় আবার কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। বিদেশে যখন যান, তখনো মনে হয় যেন ঢাকায় বসে কাজ করছেন। বাসার জন্য চারজনের অ্যান্টিভাইরাস প্যাকেজ কিনেছেন, যেখানে ছেলেমেয়েদের জন্য নিয়ন্ত্রণ–সীমানা সক্রিয় করা আছে, ইন্টারনেটের বয়স–অনুপযোগী বিষয়গুলো তাদের জন্য বন্ধ থাকে।

যোগাযোগ ও কাজ সহজ করে িদতে পারে স্মার্টফোন
যোগাযোগ ও কাজ সহজ করে িদতে পারে স্মার্টফোন

তারিক জোয়ারদারের মা যশোরে থাকেন। চিকিৎসার জন্য মাকে ১৫ দিনের জন্য ঢাকায় হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল। কাছের–দূরের অনেক আত্মীয় যাঁদের সঙ্গে অনেক বছর ধরে যোগাযোগ নেই, তাঁরা হাসপাতালে এসেছিলেন। ২১ হাজার টাকায় কেনা তারিক জোয়ারদার ব্রিফকেসের মতো পোর্টেবল তারহীন ওয়াই–ফাইনির্ভর সিসি ক্যামেরা সিস্টেম হাসপাতালের কেবিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওই সিস্টেমে একটা ১১ ইঞ্চি ট্যাবলেটের মতো পর্দা ও চারটি ক্যামেরা রয়েছে। ট্যাবলেটটায় চার ফ্রেমে ছবি দেখা যায়, এটা আবার ডিভিআরের কাজ করে। তারহীন চারটি ক্যামেরা কেবিনের চারদিকে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। কেবিনে কে কখন এসেছে, কত সময় ধরে আছে—এসব অফিস বা বাসা থেকে দেখে নিতে পারতেন। আবার সেই ১৫ দিনের দৃশ্যাবলি অবিরত রেকর্ডও হয়েছে। সুস্থ হয়ে ফেরার পর তারিক জোয়ারদার তাঁর মাকে ভিডিওগুলো উপহার দিয়েছিলেন।

তারিক জোয়ারদারের স্ত্রী ফাতিমা ইংল্যান্ডের একটি কোম্পানির জন্য ‘কনটেন্ট রাইটিং’–এর কাজ করেন। সপ্তাহে অন্তত পাঁচটি ভ্রমণ বিষয়ে লেখা জমা দিতে হয়। বিলাতের ইন্টারনেটভিত্তিক ভ্রমণ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিটির জন্য ফাতিমা কাজ করছেন দুই বছর ধরে। নিজে না গিয়েও ফাতিমা ভিআর যন্ত্রের মাধ্যমে পর্যটকদের জন্য বিশ্বের সেরা দর্শনীয় স্থানগুলোতে ঘুরে বেড়ান ও নিজের মতো করে রচনা লিখেন।

পরিবারের ফেসবুক পেজটা ফাতিমা নিজেই দেখাশোনা করেন। কখনো কখনো খোলা গলায় নিজের গাওয়া গান তুলে দেন, বোন স্টকহোম থেকে ছবি বা ভিডিও দেন, তারিক জোয়ারদারের বড় বোনের দুই ছেলে পেজটিতে সাদাকালো জমানার পুরোনো সব ছবি দিয়ে একটি আর্কাইভ বানিয়ে ফেলেছে। শাশুড়ি যশোরে থেকে তাঁর ট্যাবলেটে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন আর ইংরেজি হরফে মেসেঞ্জার গ্রুপে ছবির কী কোথায় হয়েছিল, সব লিখেন। ফেসবুক পেজটা তারিক জোয়ারদারের দেশে বা বিদেশে আত্মীয়–পরিবারের ৩২ জনের বাইরের কেউ প্রবেশ করতে পারে না। মেসেঞ্জার গ্রুপটিও তাই।

ফাতিমার দেড় হাজারের বেশি গানের সংগ্রহ আছে। তারিক জোয়ারদারেরও পুরোনো দিনের গানের বড় সংগ্রহ। যখনই যে দেশে যান, ডিস্কে সিনেমা নিয়ে আসেন। নেটফ্লিক্স বা আমাজনে পাওয়া যাবে না, এমন ৯ শতাধিক সিনেমার সংগ্রহ দিনে দিনে গড়ে তুলেছেন। সব মিলিয়ে ৪৫ হাজার টাকা খরচ করে নিজ বাসায় ইন্টারনেটের সঙ্গে চার হার্ডডিস্কের ড্রয়ার সমেত একটি ‘নাস ড্রাইভ’ বসিয়েছেন। এই ড্রাইভে প্লেক্স টিভি প্রোগ্রামটি রয়েছে। বাসার কম্পিউটারের সঙ্গে ড্রাইভের কোনো সংযোগের প্রয়োজনও নেই। মোট ২৪ টেরাবাইট হার্ডডিস্কে সব গান, সিনেমা বিষয় ধরে সাজিয়ে রেখেছেন। যেকোনো দেশ বা স্থান থেকে শুধু তারিক সাহেবের পরিবারের চার সদস্য নিজ পছন্দের গান বা সিনেমা তাদের পারিবারিক সংগ্রহশালা থেকে চালাতে পারে। এটা যেন তারিক জোয়ারদারের পারিবারিক নেটফ্লিক্স।

এই হলো তারিক জোয়ারদার পরিবারের ডিজিটাল জীবনযাপন—আনন্দময়, নিরাপদ, সহজ আর গোছানো।

লেখক: তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা