হলোগ্রাফি এবং পদার্থবিজ্ঞানের মেসি

হুয়ান মালদাছেনা
হুয়ান মালদাছেনা

আজকে যে বিষয়টা দিয়ে আলোচনা শুরু করতে চাই, সেই ধারণাটার জন্ম স্ট্রিং তত্ত্ব থেকে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এর গ্রহণযোগ্যতা এখন আর স্ট্রিং তত্ত্ব সঠিক কি না, তার ওপর নির্ভর করে না। এটি এখন সমগ্র পদার্থবিদ্যার সম্পদ। বিষয়টি হচ্ছে ‘হলোগ্রাফিক দ্বৈতবাদ’ নামে একটা কনজেকচার (conjecture), যা AdS/CFT correspondence নামে বেশি পরিচিত। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রবক্তা হুয়ান মালদাছেনা (Juan Maldacena) এখনকার পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। হুয়ান মালদাছেনা আর্জেন্টিনার লোক। কাজ করেন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির সঙ্গে সংযুক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডি, সংক্ষেপে IAS-এ। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করার জন্য এর থেকে ভালো কোনো জায়গা এই গ্রহে নেই। এখানেই কাজ করতেন আইনস্টাইন। আমার এক গুয়াতেমালান পদার্থবিদ বন্ধু তাঁর স্থপতি বাবাকে মালদাছেনার পরিচিতি দিতে গিয়ে বলেছিল, ‘ও হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞানের মেসি’। অপেক্ষাকৃত তরুণদের ভেতর মালদাছেনার থেকে বড় পদার্থবিদ আছে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না। তাই এখনকার পদার্থবিজ্ঞানে মালদাছেনার গুরুত্ব বোঝাতে এর থেকে যথার্থ বিবৃতি আর হয় না। আজকে হুয়ান মালদাছেনার এই হলোগ্রাফিক দ্বৈতবাদ নিয়ে আলোচনা করব।

এই ধারাবাহিক লেখায় আমরা স্ট্রিং তত্ত্বের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছি। আমাদের আলোচনার একটা মূল বক্তব্য ছিল এই তত্ত্ব বিভিন্ন ধারণা ও বিষয়কে একীভূত করে। মজার ব্যাপার হলো, একীভূতকরণ ছাড়াও স্ট্রিং তত্ত্বের কাছ থেকে একেবারে নতুন কিছু ব্যাপার আমরা পাই। এর একটি হলো গণিতের কাছে পদার্থবিদ্যার ঋণ শোধ। ব্যাখ্যা করি, গত কয়েক শ বছরের গণিত ও পদার্থবিদ্যার সম্পর্ক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পদার্থবিদ্যা গণিত থেকে কেবল নিয়েই গেছে, বিনিময়ে গণিতে বেশি কিছু যোগ করতে পারেনি। সম্পর্কটা অনেকটাই একমুখী। কিন্তু এই ব্যাপারটা এখন আর সত্যি নয়। স্ট্রিং তত্ত্ব গণিত গবেষণার ক্ষেত্রেও নতুন ধারণা ও দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। এর একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে মিরর সিমেট্রি (Mirrorsymmetry) বলে একটা বিষয়। এই গাণিতিক ধারণা স্ট্রিং তত্ত্ব থেকে এসেছে। বিষয়টা একটু জটিল, সুযোগ পেলে অন্য কোথাও আলোকপাত করব।

আজকের মূল আলোচনায় ফেরা যাক। আমার ধারণা, গত বিশ-পঁচিশ বছরে স্ট্রিং তত্ত্ব এবং তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় কাজটা হচ্ছে হলোগ্রাফিক দ্বৈতবাদ বা AdS/CFTcorrespondence। এটা মূলত একটা কনজেকচার (conjecture)। কারণ, এই ধারণা এখনো ঠিক গাণিতিকভাবে প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু এর বিশুদ্ধতা নিয়ে পদার্থবিদদের মনে কোনো সন্দেহ নেই বলা চলে। এর হাজার হাজার গাণিতিক পরীক্ষা করা হয়েছে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই হলোগ্রাফিক দ্বৈতবাদ একটা আজব ধরনের প্রস্তাব করে। এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের দুটি তত্ত্বের ভেতর একধরনের দ্বৈতবাদের কথা বলে। তত্ত্বগুলো এতটাই আলাদা যে এদের ভেতর কোনো রকম মিল চিন্তাই করা যারা না। আরও বড় কথা হলো, তত্ত্ব দুটি ভিন্ন ভিন্ন স্থান, কাল ও মাত্রায় সংজ্ঞায়িত। হুয়ান মালদাছেনা আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে এই অদ্ভুত প্রস্তাবটা দিয়ে সবাইকে একরকম হকচকিয়ে দেন এবং হলোগ্রাফিক দ্বৈতবাদ নিয়ে লেখা তাঁর গবেষণাপত্রটা এখন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বেশিবার সাইটেড পেপারগুলোর একটি। এর সাইটেসন সংখ্যা ১৪ হাজারের ওপরে। সাইটেসন সংখ্যা হচ্ছে কতবার এই গবেষণাপত্র অন্য গবেষকেরা তাঁদের গবেষণাপত্রের কাজে ব্যবহার করেছেন, তার একটা হিসাব। এই সাইটেসন নম্বরটার গুরুত্ব বোঝাতে বলে রাখি স্বয়ং আইনস্টাইনের স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটার সাইটেসন নম্বর ৪ হাজারের একটু কম। যদিও সাইটেসন নম্বরই একটা গবেষণাপত্রের গুরুত্বের মূল মাপকাঠি নয়, তাই এভাবে সরাসরি তুলনা ঠিক যথার্থ নয়।

হলোগ্রাফিক দ্বৈতবাদ। ছবি: ড. সাজিদ হক
হলোগ্রাফিক দ্বৈতবাদ। ছবি: ড. সাজিদ হক

যা হোক, এই ধারণা ব্যাখ্যা করার আগে একটা ব্যক্তিগত গল্প বলা যেতে পারে। কয়েক বছর আগে নিউইয়র্কের স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইমনস সেন্টারে গিয়েছিলাম স্ট্রিং থিওরির একটা কর্মশালায়। লক্ষ করেছি বাংলাদেশের গবেষকেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অন্তর্মুখী হন, নতুন পরিবেশে তাদের খাপ খাওয়াতে বেশ সময় লাগে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। এর অন্য একটা কারণ হতে পারে আমার ব্যক্তিগত হীনম্মন্যতা। বিজ্ঞান ও গণিতে আমাদের অর্জন বড় কম—বলার মতো না আসলে। জাতিগত অন্তর্মুখিতা বা ব্যক্তিগত হীনম্মন্যতা—যেকোনো কারণেই হোক, লাঞ্চের সময় অন্য সবার সঙ্গে না বসে আমি একেবারে একা একটা ভিন্ন টেবিলে বসলাম। মাথা নিচু করে খাচ্ছি এমন সময় একজন সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, সে কি আমার সঙ্গে বসতে পারে? তাকিয়ে দেখি ব্যক্তিটি হচ্ছেন হুয়ান মালদাছেনা। আমার পিএইচডি অ্যাডভাইজার আর মালদাছেনা দুজনেই একই সময় প্রিন্সটনে পিএইচডি করেছেন এবং বেশ ভালো বন্ধু। কাজেই মালদাছেনার সঙ্গে কথা শুরু করতে আমার তেমন সমস্যা হয়নি। তবে সার্বিকভাবে মালদাছেনার সঙ্গে এই লাঞ্চটা খুব ভালো যায়নি। তখন আমি যে বিষয়টা নিয়ে কাজ করছিলাম, তা নিয়ে ওকে আমি একটা প্রশ্ন করেছিলাম। সত্যি বলতে কি, ওর উত্তর আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। তা ছাড়া মিনিট দশেকের মধ্যেই আমাদের টেবিলে লোক জমে গেল। সবাই মালদাছেনার কাছে কিছু না কিছু শুনতে চায়।

হলোগ্রাফিক দ্বৈতবাদে ফিরে আসা যাক। এই দ্বৈতবাদ যে দুটি ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্বকে সম্পৃক্ত করে, তার একটি হলো এক বিশেষ ধরনের কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তত্ত্ব, যাকে কনফরমাল ফিল্ড থিওরি (সংক্ষেপে CFT) বলা হয়। সহজভাবে চিন্তা করার জন্য এটাকে তড়িৎ চুম্বকীয় বলের কোয়ান্টাম তত্ত্বের মতো মনে করা যেতে পারে। ধরা যাক এই তত্ত্ব চার মাত্রার বিশ্বে সংজ্ঞায়িত। এখন গাণিতিকভাবে এই চার মাত্রার সঙ্গে আমরা একটি (বা একাধিক) বাড়তি মাত্রা যোগ করতে পারি। ঠিক এই রকমই একটা বেশি মাত্রার বিশ্বে দ্বিতীয় তত্ত্বটি সংজ্ঞায়িত। আরও মজার বিষয় হচ্ছে, এই দ্বৈত তত্ত্ব একটি বিশেষ ধরনের মহাকর্ষীয় তত্ত্ব। বিশেষ এই অর্থে যে এই মহাকর্ষীয় তত্ত্বের একটা নির্দিষ্ট জ্যামিতিক গঠন আছে, যাকে আমরা অ্যান্টি ডি সিটার স্পেস (সংক্ষেপে AdS) বলি। এ কারণেই এই দ্বৈতবাদকে AdS/CFT correspondence বলা হয়। মালদাছেনা তাঁর প্রথম প্রস্তাবে এই দ্বৈত তত্ত্ব একটা দশ মাত্রার সুপার স্ট্রিং তত্ত্ব ধরেছিলেন। আর মাত্রার এই ভিন্নতার জন্যই এই দ্বৈতবাদকে হলোগ্রাফিক দ্বৈতবাদ বলা হয়।

মাত্রার ভিন্নতা ছাড়াও তত্ত্ব দুটির আরও কিছু অদ্ভুত বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্য আছে। তার একটি হলো, বেশি মাত্রার মহাকর্ষীয় তত্ত্বের ওপর গাণিতিক পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা বহু ক্ষেত্রেই অনেক সহজ, কম মাত্রার দ্বৈত তত্ত্বটির তুলনায়। এটাই মূলত এই হলোগ্রাফিক দ্বৈতবাদের মূল শক্তি। যেসব কম মাত্রার দ্বৈত তত্ত্ব বেশ জটিল, আমরা পদার্থবিদ্যার প্রচলিত গাণিতিক অস্ত্র দিয়ে যাদের ঘায়েল করতে পারি না, তাদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত সহজ দ্বৈত তত্ত্বটা ব্যবহার করা হয়। পরীক্ষা–নিরীক্ষা যা করার এই তত্ত্বের ওপর করে দ্বৈতবাদের অভিধান ব্যবহার করে অপেক্ষাকৃত জটিল তত্ত্বটি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই হলোগ্রাফিক দ্বৈতবাদ স্ট্রিং তত্ত্বের এক বিরাট সাফল্য। আজকাল এই ধারণা পদার্থবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায়ও ব্যবহার করা হচ্ছে।

তত্ত্ব হিসেবে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি স্ট্রিং তত্ত্বকে নিয়ে সমালোচনাও কম নয়। এই ধারাবাহিক লেখাটা অসম্পূর্ণ হবে যদি তার কিছুটা এখানে উল্লেখ না করা হয়। সমালোচনার কেন্দ্রে আছে মূলত তত্ত্বের সঙ্গে পরীক্ষা–নিরীক্ষাকে সম্পৃক্ত করতে না পারার অক্ষমতা। এর মূল কারণটা আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। স্ট্রিং পরীক্ষাগারে দেখা বা এ–সম্পর্কিত কিছু সরাসরি পরিমাপ করা আমাদের বর্তমান পরীক্ষা–নিরীক্ষা করার ক্ষমতার অনেক বাইরে। আসলে স্ট্রিং তত্ত্ব এক্সপেরিমেন্ট থেকে বহুদূর অগ্রগামী। বিজ্ঞানে তত্ত্ব এবং এক্সপেরিমেন্টের উন্নতি হওয়া উচিত হাত ধরাধরি করে, এ ক্ষেত্রে সেই ব্যাপারটা মোটেই ঘটেনি। দ্বিতীয়ত, এই তত্ত্ব জটিল গণিত দিয়ে বাঁধা। অন্য বিষয়ের লোকজন তো বাদই দিলাম, বহু সাধারণ পদার্থবিজ্ঞানীর গণিতে সেই দক্ষতা থাকে না, যা দিয়ে এই তত্ত্বকে ঠিকমতো বোঝা সম্ভব হয়।

আসলে বহুমাত্রিক জগতের ধারণা যেমন চিন্তা করা কঠিন, তার গাণিতিক বর্ণনাও বেশ জটিল একটা বিষয়। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে পারে। ধরুন, আপনার কাছে মোটাসোটা একটা বই আছে। বইটার পাতাগুলোর পুরুত্ব খুবই কম, কাজেই পৃষ্ঠাসংখ্যা অনেক বেশি। ধরা যাক, এই বইয়ের ৫০ নম্বর পাতায় একটা পোকার ছবি আছে। এই পাতাকে আপনি কল্পনা করতে পারেন একটা দুই মাত্রার বিশ্বের সঙ্গে, যেখানে কেবল দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আছে, কিন্তু উচ্চতা বলে কিছু নেই। এখন কল্পনাকে আরও বাড়িয়ে ৫০ নম্বর পাতার এই পোকাকে ধরে নিন জীবন্ত। যেহেতু একটা দুই মাত্রার বিশ্বে (৫০ নম্বর পাতা) এই পোকার বাস, কাজেই এই পোকাকেও হতে হবে দুই মাত্রার, অর্থাৎ এর কোনো উচ্চতা থাকবে না। আশা করি আমাকে অনুসরণ করতে পারছেন। এখন ধরা যাক, এই পাতার ওপর আপনি একটা চায়ের কাপ রাখলেন। এখন প্রশ্ন হলো, পোকাটি কি চায়ের কাপটা দেখতে পাবে বা এটা যে একটা চায়ের কাপ, তা বুঝতে পারবে? আসলে পারবে না। কারণ, পোকাটার জগতে উচ্চতা বলে কিছু নেই। কাজেই কাপটার যে অংশ দুই পাতার ওপরে আছে, সেই বৃত্তাকার তলাটা শুধু বুঝতে পারবে। কাজেই একটা দুই মাত্রার পোকার জন্য তিন মাত্রার চায়ের কাপ সম্পূর্ণ অজানাই থেকে যাবে।

তিন মাত্রার বইয়ের ৫০ নম্বর পাতার পোকার ২ মাত্রার পাতার ওপর রাখা কাপ। ছবি: ড. সাজিদ হক
তিন মাত্রার বইয়ের ৫০ নম্বর পাতার পোকার ২ মাত্রার পাতার ওপর রাখা কাপ। ছবি: ড. সাজিদ হক

একইভাবে আমরা একটা চার মাত্রার (তিনটি স্থান মাত্রা ও সময়) জগতে বাস করি। কাজেই দশ মাত্রা নিয়ে আমাদের মস্তিষ্ক কোনো ছবি তৈরি করতে পারে না। দশ মাত্রার মহাবিশ্ব আমাদের জন্য ভয়াবহ রকমের জটিল। তবে পার্থক্য হলো আমরা মানুষ, পোকা না, আমাদের হাতে আছে ‘গণিত’ নামের একটা অসম্ভব শক্তিশালী অস্ত্র। এই গণিত দিয়ে আমরা এই বাড়তি মাত্রাগুলো নিয়ে চিন্তা করতে পারি। এই মাত্রাগুলো কী রকমের হতে পারে, তা ধারণা করতে পারি। কিন্তু এখানেও সমস্যা আছে। এই বাড়তি মাত্রাগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিতে বর্তমান গণিতও মনে হচ্ছে পুরোপুরি সক্ষম নয়। এই বাড়তি মাত্রাগুলো বোঝার জন্য এখনকার গণিত থেকে সবচেয়ে বোধগম্য যে ধারণা আমরা পাই, তার নাম হচ্ছে ‘কালাবি ইয়াও ম্যানিফোল্ড’। কালাবি ইয়াও ম্যানিফোল্ড হচ্ছে একটা ছয় মাত্রার বিশ্ব, যার জ্যামিতিক প্রকৃতি আমাদের জানা। কাজেই স্ট্রিং তত্ত্বের বাড়তি ছয় মাত্রার কমপ্যাকটিফাইড (আগের লেখায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে) বিশ্বকে আমরা কালাবি ইয়াও হিসেবে ধরে নিই। কারণ, কালাবি ইয়াও ম্যানিফোল্ডের বাইরে অন্য ধরনের স্থান সম্পর্কে আমাদের পুরোপুরি জ্ঞান নেই। কিন্তু এই বাড়তি মাত্রাগুলো যে কালাবি ইয়াও ধরনের হবে, তার কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।

মাত্রা বেশি থাকায় আর একটা খুব বড় সমস্যা তৈরি হয়। আবার বইয়ের উদাহরণটাতে ফিরে যাওয়া যাক। আগেই বলছি, তিন মাত্রার বইয়ের ভেতর বহু দুই মাত্রার পাতা ঢোকানো আছে। প্রতিটা পাতা আমাদের দুই মাত্রার পোকাটার জন্য একটা সম্ভাব্য বিশ্ব হতে পারে। তেমনিভাবে দশ মাত্রার মহাবিশ্বে অসংখ্য অসংখ্য চার মাত্রার বিশ্ব থাকতে পারে। কল্পকাহিনিতে এদের প্যারালাল মহাবিশ্ব (ParallelUniverse) হিসেবে দেখানো হয়। সমস্যাটা হলো, এখান থেকে আমাদের পরিচিত চার মাত্রার বিশ্ব খুঁজে বের করা বালুর ট্রাকের ভেতর থেকে সুই খুঁজে বের করার থেকেও অনেক অনেক গুণ বেশি কঠিন। এই কঠিন প্রশ্নের একটা উত্তর অনেকে এভাবে দেন যে আমরা সেখানেই বাস করি, যেখানে আমরা বাস করতে পারি। আমরা সেই মহাবিশ্বে বাস করি, যেখানে পৃথিবী নামক বাসযোগ্য গ্রহ তৈরি হয়েছে, যেখানে অনেক মৌলিক কণা যেমন ইলেকট্রন, প্রোটন এসব আছে। আমাদের এই মহাবিশ্ব সব জায়গাতে দেখতে এক রকম এবং তা সম্প্রসারিত হচ্ছে। যদি এসব না থাকত, তাহলে আমদের অস্তিত্বও থাকত না এবং এই সব দেখার, চিন্তা করার জন্যও কেউ থাকত না। এই বিচিত্র সমাধানকে এনথ্রপিক সমাধান বলা হয় এবং বহু পদার্থবিদ এটা মানতে পারেন না। বলা ভালো, এখন পর্যন্ত এই বিষয়টার খুব ভালো কোনো সমাধান আমাদের নেই। এসব কিছু মিলিয়েই স্ট্রিং তত্ত্ব যেন অন্য ভুবনের তত্ত্ব।

আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিমত হলো, এই তত্ত্বের খুব সামান্য অংশই আমরা আসলে বুঝি। স্ট্রিং তত্ত্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অনেকটা বিশাল হাতির শরীরের এক জায়গা স্পর্শ করে হাতি সম্পর্কে ধারণা করার মতো। কাজেই অনেক মৌলিক প্রশ্নের উত্তরই আমরা জানি না। তা ছাড়া পদার্থবিজ্ঞানের বক্তব্য তো পাথরে খোদাই করা নয়, এর ধ্যানধারণা বহমান। নতুন চিন্তা, নতুন ধারণা আগের অসম্পূর্ণ ধারণাকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করে চলেছে। আর আমাদের মনে রাখা উচিত, মহান তত্ত্ব ছাড়া কোনো বিজ্ঞান খুব বেশি আগাতে পারে না। আজকের দিনে আমরা শুধু পর্যবেক্ষণ এবং তা থেকে পাওয়া তথ্য–উপাত্তকেই বিজ্ঞান হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তথ্য–উপাত্ত আমাদের কেবলই বিভিন্ন পরিমাপকের মধ্যকার correlation সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে। কিন্তু চিন্তার বিপ্লব আনতে হলে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কীভাবে কাজ করে, তা বুঝতে হলে প্রয়োজন বিশুদ্ধ তত্ত্বের। যেমন নিউটন, আইনস্টাইন বা ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক দিয়ে গেছেন। এডওয়ার্ড উইটেন কোনো এক জায়গায় স্ট্রিং তত্ত্ব নিয়ে বলেছিলেন, ‘যে তত্ত্বের সঙ্গে এত চমৎকার গণিত জড়িয়ে আছে, তার সবকিছু ভুল হতে পারে না।’ বিবৃতিটা সুন্দর এবং অর্থবহ, তবে এর প্রমাণ হবে ভবিষ্যতের পদার্থবিদদের হাতে। আমরা আশা করব, এই বিষয়ে বাংলাদেশি পদার্থবিজ্ঞানীদের কিছুটা হলেও ভূমিকা থাকবে।

ড. সাজিদ হক: শিক্ষক ও গবেষক, স্ট্রিং থিওরি অ্যান্ড কসমোলজি, ইউনিভার্সিটি অব উইন্ডসর, কানাডা
ই-মেইল: [email protected]