আইডিয়াই জেফ বেজোসের নির্মাতা

জেফ বেজোস শুধু নতুন নতুন ধারণা দিয়েই এগিয়ে গেছেন নানা উদ্যোগে
জেফ বেজোস শুধু নতুন নতুন ধারণা দিয়েই এগিয়ে গেছেন নানা উদ্যোগে

ঠিক এই মুহূর্তে হয়তো একটু বিপাকেই আছেন জেফ বেজোস। ২৫ বছরের গাঁটছড়া ছুটে যাচ্ছে। অথচ সিকি শতাব্দীর জীবনসঙ্গীর সঙ্গে বিচ্ছেদের এই মুহূর্তেও একটু উদাস হওয়ার সুযোগ নেই তাঁর। বরং আরও বেশি সচেতন হয়ে হিসাবের খাতা খুলে বসতে হচ্ছে তাঁকে। কারণ এই বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে তিনি শীর্ষ ধনীর মুকুটটিও হারাচ্ছেন। তবে স্বভাব নেতা বেজোস ঘুরে দাঁড়াবেন নিশ্চয়ই। এই নিশ্চয়তার পেছনের জ্বালানিটি দিচ্ছেন স্বয়ং বেজোসই তাঁর উত্থানের গল্প দিয়ে।

 সবকিছুর মূলে নতুন ধারণা

নতুন ধারণা ও নির্মাণের ক্ষমতাই জেফ বেজোসের উত্থানের মূলে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি মোগল বললেই একটি দারুণ ক্যাম্পাসের চেহারা চোখের সামনে ভাসলেও আমাজন ডটকমের ক্ষেত্রে কিন্তু তেমনটি নয়। বরং এ ক্ষেত্রে চোখের সামনে আমাজন বলতে অসংখ্য কর্মীর নিরন্তর ছুটে চলার দৃশ্যই চোখে ভাসে। এর মানে এই নয় যে আমাজনের কোনো সদর দপ্তর নেই। আছে। একটি নয়, দু-দুটি। যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের প্রথম সদর দপ্তরে রয়েছে ৪৫ হাজার কর্মী ও নির্বাহী। আর দ্বিতীয় সদর দপ্তরটি একটি নয়, দুটি শহরে হতে যাচ্ছে। এই দ্বিতীয় সদর দপ্তরকে আতিথ্য দিতে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল দুই শতাধিক শহর। শেষ পর্যন্ত দুটি শহরের মধ্যে ভাগ করে দিতে হয়েছে। এ হিসাবে আমাজনের সদর দপ্তর একটি নয়, তিনটি। কিন্তু সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা পৌনে ছয় লাখ কর্মীর জন্য এগুলোর কোনোটিই আমাজন নয়। আমাজন ও এর সদর দপ্তর সেখানেই, যেখানে থাকেন এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জেফ বেজোস, মাঝেমধ্যে যার ঠিকানা ‘ডে ওয়ান টাওয়ার’। এই নামটিও এসেছে বেজোসের উত্থানের মূলমন্ত্র থেকেই।

বেজোস প্রতিটি দিনকেই লড়াইয়ের প্রথম দিন গণ্য করে ময়দানে নামেন। আর এই মূলমন্ত্রের বলেই তিন বছরে আমাজনের শেয়ারদর বেড়েছে ২৭০ শতাংশ। গত বছরের অক্টোবরে শেষ হওয়া অর্থবছরে মুনাফা আগের চেয়ে ১০৩ শতাংশ বেড়েছে। নিজেদের এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছে যে স্টিভ জবসের অ্যাপলকে ডিঙিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে দামি কোম্পানি হয়ে যাওয়াটা ছিল সময়ের ব্যাপার। স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদে সম্পদ ভাগ হয়ে যাওয়ার কারণে এটা আপাতত হচ্ছে না। কিন্তু এই অভিমুখ যে অক্ষুণ্ন থাকবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কারণ এত উচ্চতায় উঠেও বেজোস তাঁর প্রতিষ্ঠান নিয়ে নিশ্চিত নন।

 সদা অতৃপ্তি, সদা সংশয়

সদ্য শুরু করা কোনো এক স্টার্টআপ কোম্পানির সিইওর মতোই তাঁর কণ্ঠে অতৃপ্তি ও সংশয়। ‘বাজারের অসীম সম্ভাবনা’র সামনে নিজের অর্জনকে রীতিমতো প্রাথমিক পর্যায়ের বলেই মনে করেন ৫৪ বছর বয়সী বেজোস। তাঁর দৃষ্টিতে যেকোনো ‘বাস্তব লক্ষ্যের’ জন্যই বাজার বাধাহীন। তাঁর এই বিশ্বাসের ভিত তৈরি করেছেন তিনি নিজেই। এ ক্ষেত্রে তাঁকে ভাগ্যবানও বলতে হবে। খুচরা বাজারকে বদলে দিয়ে এবং ক্লাউড মার্কেট হিসেবে আমাজন ওয়েব সার্ভিস (এডব্লিউএস) চালু করে শুধু সাফল্যই দেখেছেন তিনি। ফলে তাঁকে সীমার কথা ভাবতে হয়নি। সীমার বাঁধন টুটে ছুটে চলা বেজোসের কোম্পানি কোনো অঘটন না ঘটলে এ বছরই সম্পদের দিক থেকে ২১ হাজার কোটির সীমা ডিঙিয়ে ফেলত। তাঁর এই বাধাহীন ছুটে চলাই তটস্থ রাখে সবাইকে।

দিগ্বিজয়ী মোঙ্গলদের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীর দুর্ভাবনার নাম হয়ে উঠতে পারাটা নিশ্চয়ই তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেন তিনি। নির্মম ও দীর্ঘ খেলার দম এই সবই বেজোসের অন্যতম শক্তি হলেও গত কয়েক বছ‌রেও তাঁকে যে জিনিসটি অন্যদ‌ের কাছ থেকে আলাদা করেছে, তা হলো নতুনত্ব এবং পুরোনোকে নতুন ভাবনায় বদলে দিয়ে নবচাহিদা সৃষ্টি। এই তিনের সমন্বয়েই তিনি বাজার থেকে অন্যদের হটিয়ে নিজের রাজ কায়েম করতে পারছেন।

উদ্ভাবনী ক্ষমতাই বেজোসকে অন্যদের থেকে এগিয়ে রেখেছে। ফোর্বসসাময়িকী বিশ্বের সেরা বিজনেস লিডার খুঁজে পেতে তিনজন অধ্যাপকের সঙ্গে একযোগে কাজ করে। ওই তিন অধ্যাপকই বর্তমানে জনপরিসরে সুনাম ও প্রভাব, মূল্য সৃষ্টি ও সংযোজন, নির্বাহী ও উদ্ভাবনী দক্ষতা—সব বিচারেই অন্য সব বিজনেস লিডার থেকে বহুগুণে এগিয়ে রেখেছেন বেজোসকে। এমনকি ‘ওরাকল অব ওমাহা’-খ্যাত শীর্ষ ধনী ওয়ারেন বাফেট যখন বলেন, ‘জেফ বেজোস যা করেছে ও করতে চলেছে, তাই আমার দেখা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন।’ তখন বেজোসের দিকে পুরো চোখ মেলে তাকানো ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। বাফেটের মতে, বেজোস দুটি ভিন্ন ধারার ও ভীষণ বড় দুটি বাজারকে (খুচরা ও ক্লাউড) একই সঙ্গে শুধু নেতৃত্বই দিচ্ছেন না, তার অভিমুখও বদলে দিচ্ছেন। এই দুটি ক্ষেত্রের সঙ্গেই সংযোগ রাখতে হয় সব ব্যবসার। যে ব্যবসাই হোক না কেন, খুচরা বাজারে আসতেই হবে। ঠিক একই কথা সত্য ডিজিটাল বাণিজ্যের বেলায়ও। এই দুইয়ের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে বেজোস তাই অনায়াসে ছড়ি ঘোরাতে পারছেন। যেকোনো ব্যবসার সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করার সুযোগ তাঁর হাতে বেশি থাকছে। পছন্দমতো অন্য সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে বিচরণ করতে পারছেন। বর্তমানে অন্তত চারটি খাতের প্রতিটিতে বেজোসের রয়েছে শতকোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ। স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন, ইলেকট্রনিকস ও বিজ্ঞাপনে এই বিনিয়োগ দিয়ে আমাজনের ভিতই শুধু শক্তিশালী হয়নি, কয়েক লাখকোটি ডলার মুনাফার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা প্রযুক্তিতে তাঁর বিনিয়োগ নতুন এক দিগ‌ন্তের উন্মোচন করতে যাচ্ছে, যা এমনকি ভেঙে দিতে পারে পুরোনো স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থাকে।

 উত্থানের পেছনে পরিমিতিবোধ

বেজোসের এই উত্থানে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে‌ তাঁর পরিমিতিবোধের। তাঁকে নিয়ে বিস্তর জন-আগ্রহ থাকলেও এমনকি নিজের মালিকানায় ওয়াশিংটন পোস্ট-এর মতো একটি পত্রিকা থাকার পরও সাক্ষাৎকারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে জনপরিসরে তাঁর উপস্থিতি একেবারেই কম।

আমাজনের ভেতরে শুধুই হ্যাঁ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন টুইটারে তাঁকে ও তাঁর প্রতিষ্ঠানকে চরম আঘাত করছেন, তিনি তখন নীরব। ১৯৯৫ সালে বেজোসের বাড়ির গ্যারেজে শুধু বই বিক্রির জায়গা হিসেবে আমাজন নামে যে অনলাইন বাজারের যাত্রা, তা এখন আক্ষরিক অর্থেই সর্বব্যাপী। বিস্তার হচ্ছে সবদিকেই। আর এই বিস্তারের শিল্পী হিসেবে হাজির আছেন বেজোস, যার হাতে থাকা প্যালেটে নেই এমন কিছু নেই। তাই এই বাধাহীন যুগে দাঁড়িয়ে আমাজনের অভ্যন্তরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘হ্যাঁ’।

জেফ বেজোসের ভাষ্যে, ‘প্রচলিত কাঠামোয় নতুন কোনো ধারণাকে অনেক বাধা পেরোতে হয়। একজন কর্মীক‌ে নতুন ধারণাটি নিয়ে যেতে হয় বসের কাছে, ওই বসকে তাঁর বসের কাছে এভাবে এক লম্বা চেইন। এর যেকোনো একটি পর্যায়ে একটি না-ই পুরো সম্ভাবনাকে হত্যা করে ফেলতে পারে। আর এটিই ক্ষুদ্র উদ্যোগের কাছে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের নতিস্বীকারের কারণ।’

আদতে জেফ বেজোস আমাজনকে এমনভাবে গড়ে তুলেছেন যেন হ্যাঁ–টি তিনি সব সময় বলে যেতে পারেন। না-এর পথটি যেন একেবা‌রে সংকুচিত থাকে। যেকোনো সম্ভাবনাকে বুকে টেনে নেওয়ার শক্তি অর্জনের পথেই হেঁটেছেন তিনি। এখনো সেই পথেই হাঁটছেন। শুধু বইয়ের অনলাইন দোকান হিসেবেই থেকে যেতে পারত আমাজন, যেমনটি ‘জ্যাপুস’ থেকে গেছে জুতার দোকান হিসেবে। কিন্তু আমাজন তা থাকেনি। আর থাকেনি বলেই আমাজন আজ সুই থেকে এয়ারক্রাফট—সব বিক্রি করছে। এর বেড়ে ওঠার নেশাই একে বড় করেছে। আর জ্যাপুসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণতি খুঁজে আত্তীকৃত হয়েছে আমাজনেই। এই যে শক্তি, তার পেছনে রয়েছে ওই ‘হ্যাঁ’-এর শক্তি। এই ‘হ্যাঁ’ ধারণার প্রতি, সম্ভাবনার প্রতি। বেজোসের ভাষায়, ‘নতুন ধারণার বলেই আমি আজ এখানে।’ করপোরেট বিশ্বের জন্য বেজোসের দিক থেকে একটাই অনুচ্চারিত বার্তা: ‘টিকে থাকতে হয় উদ্ভাবন করো, নয়তো জেফ বেজোসই তা করে ফেলবে।’